আশাবাদও যখন ঠুনকো
Pandemic

অন্ধকারের ভেতর থেকে দেখা দিচ্ছে ‘অসম্পূর্ণ কদাকার জলহস্তী সব’

শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘নির্মাণ ও সৃষ্টি’ বইয়ের একটি অংশে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথের আঁকা প্রাগৈতিহাসিক রংরূপগুলির সৃষ্টির কথা।

Advertisement

কৌশিক সেন

শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০২০ ০০:০১
Share:

দুঃসময়: রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি

এক দিন ‘রাণী চন্দ’-কে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘‘একটা ছবি আঁকিস তো, অসম্পূর্ণ কদাকার জলহস্তী সব— এখনো সম্পূর্ণ তৈরি হয় নি— তারা সব দ্যাখা দিচ্ছে অন্ধকারের ভিতর থেকে’’....

Advertisement

শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘নির্মাণ ও সৃষ্টি’ বইয়ের একটি অংশে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথের আঁকা প্রাগৈতিহাসিক রংরূপগুলির সৃষ্টির কথা। ‘অসমাপ্ত কীর্তি’-র মতো, মানবসভ্যতায় বর্বরতার পুনরাবির্ভাবের একটা প্রতিরূপ খুঁজছিলেন রবীন্দ্রনাথ। হিজিবিজি নয়, ইচ্ছে করেই ধরতে চেয়েছিলেন আদিম বিশৃঙ্খলের একটা রূপ। তাঁর ‘কালান্তর’-এর লেখাগুলিতে রাষ্ট্রসঙ্কটের নানান ছবি তুলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ কেমন ভাবে পৌঁছেছিলেন ওই সব আদিম প্রতিমায়, তা স্পষ্ট করে বিশ্লেষণ করেছেন শঙ্খবাবু। যেমন ‘হলকর্ষণ’-এর মতো প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন: ‘‘মানুষের আরম্ভ আদিম বর্বরতায়, তারও প্রেরণা ছিল লোভ; মানুষের চরম অধ্যায় সর্বনেশে বর্বরতায়, সেখানেও লোভ মেলেছে আপন করাল কবল।’’

এই বছর, এই দেশে, এই রাজ্যে, এই শহরে বসে থাকতে থাকতে যখন দুনিয়ার নানান কোণের নানান খবর অনিবার্য গতিতে এসে আছড়ে পড়ে আমাদের সামনে, তখন আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের শিউরে ওঠাটা আশ্চর্য নয়। মানুষের চরম অধ্যায় কি শুরু হয়ে গেল? না কি, তা ছিল চিরকাল ধরে? অবিরাম ঢেউয়ের মতো, যা বারংবার আঘাত করে সভ্যতাকে সরিয়ে দিতে চেয়েছে তার গন্তব্য থেকে। অপরিমিত লোভে কেবলই বড় হয়ে উঠেছে প্রবল রাষ্ট্রগুলির গ্রাস। রবীন্দ্রনাথের লেখায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে সে বার্তা।

Advertisement

‘‘যে নীচে আছে তাকে চিরকালই নীচে চেপে রাখতে চায় তারা— তারা শুধু সেই শান্তি চায়, যে শান্তিতে পৃথিবীর সমস্ত ক্ষীরের বাটি চেটে নিরাপদে খাওয়া যেতে পারে।’’

আমাদের ভারতবর্ষ যাঁরা এই মুহূর্তে শাসন করছেন, তাঁরাও শান্তি চান। অখণ্ড শান্তি।

তাই ২০১৮ সালের জুন মাস থেকে বহু শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মী, কবি-সাহিত্যিকদের এলগার পরিষদ মামলায়, মিথ্যা প্রচার ও প্রমাণ দেখিয়ে নির্বিচারে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ‘হুইলচেয়ার’-এ বসে থাকা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রেফতার হওয়া অধ্যাপক জিএন সাইবাবা-র কর্কট রোগাক্রান্ত মৃত্যুপথযাত্রী মায়ের শেষ ইচ্ছে পূরণ করে না প্রশাসন, শান্তি রক্ষার জন্যই সম্ভবত। ছেলেকে শেষ বারের মতো না দেখেই মৃত্যু হয় ৭৪ বছর বয়সি মায়ের। মুম্বই হাইকোর্ট-এর নাগপুর বেঞ্চ, সাইবাবার জামিন ও শর্তাধীন মুক্তির আবেদন নাকচ করে। এতটাই বিপজ্জনক অপরাধী তিনি। মাথা থেকে পা পর্যন্ত প্রায় অচল-অশক্ত একটা মানুষ, এক অধ্যাপক, এতটাই বিপজ্জনক আজ রাষ্ট্রের কাছে। একই ভাবে রাজধানীতে দাঙ্গার ষড়যন্ত্রী হিসেবে একের পর এক গ্রেফতার করা হচ্ছে সমস্ত প্রতিবাদী কণ্ঠকে। ছাত্র-ছাত্রী, অধ্যাপক, সমাজকর্মী, কেউ বাদ পড়ছে না। ‘নাগরিকত্ব বিল’-এর বিরুদ্ধে পথে নামা সমস্ত বিরুদ্ধ স্বরকে কী নিপুণ উপায়ে স্তব্ধ করা হচ্ছে, এবং কী অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে, তা ভাবলে স্তম্ভিত হতে হয়। উল্টো দিকে এই শ্মশানের শান্তিকে চিরস্থায়ী করার জন্য পুলিশ-প্রশাসন গ্রেফতার তো দূর স্থান— তদন্ত করেও দেখছে না ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’-র বিভিন্ন নেতাদের প্রকাশ্যে বুক ঠুকে করে যাওয়া নানান প্ররোচনামূলক, হিংসাত্মক বক্তব্যগুলো সম্পর্কে। কপিল মিশ্র, অনুরাগ ঠাকুর, মিলিন্দ একবোটে, শম্ভাজি ভিডে’রা তাই সুনাগরিক ও শান্তিরক্ষাকারী দূত— সাইবাবা, সুধা ভরদ্বাজ, সোমা সেন, রোনা উইলসন, ভারাভারা রাও থেকে হ্যানি বাবু কিংবা অপূর্বানন্দ ঝা, এঁরা সবাই নাকি চক্রান্তকারী, যড়যন্ত্রী এবং অবশ্যই নিশ্চিত ভাবেই দেশদ্রোহী। কারণ, এঁরা প্রশ্ন করেছেন, বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন আমাদের দেশের ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলটির বিরুদ্ধে।

‘করোনা’র আবহে বিপর্যস্ত, বিপন্ন মানুষ এক দিকে প্রাণভয়ে শঙ্কিত। অন্য দিকে অর্থনৈতিক ভাবে চরম অনিশ্চয়তায় গ্রস্ত। তাদের ভাবার সময় কোথায়, জানবার মতো মনের জোরটাই বা কোথায়, যে আসলে ‘কিছু’ প্রতিবাদী কণ্ঠকে নয়, স্তব্ধ করা হচ্ছে সব রকমের বিরুদ্ধ মতকেই। সংসদ ভবন অথবা দেবতার বিগ্রহের সামনে সাষ্টাঙ্গ প্রণামে রত আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে এই মুহূর্তে আমাদের দেশে তৈরি হয়েছে এক ‘মিস্টিক ফ্যাসিজ়ম’— এক ‘নিগূঢ় রহস্যময় ফ্যাসিবাদ’।

ইতিহাসের পাতা উল্টোলেই জানা যাবে এর পত্তন হয়েছিল ১৯৩০ সালের ইটালি দেশের মিলানে। এমন এক পুরাণ-নির্ভর আধ্যাত্মিক, রহস্যময় ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়েছিল, যা বিবশ করে রেখেছিল সেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে। প্রশ্নহীন আনুগত্য তৈরি হয়েছিল সেই দেশে। শুধু গায়ের জোরে নয়, এক দার্শনিক আধ্যাত্মিক ভাবনা-চিন্তার প্রভাবে বেনিটো মুসোলিনি-র প্রতি শর্তহীন সমর্থনে উত্তাল হয়েছিল ইটালি ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত। ইতিহাস সাক্ষী, প্রথম জাতীয়তাবাদী হিন্দু নেতা, যিনি মুসোলিনির সেই ধ্বংসাত্মক, স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রচালনার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বেশ কিছু কাল ইটালিতে আতিথ্যগ্রহণ করেছিলেন, তাঁর নাম বি এস মুঞ্জে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ-এর গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ-এর প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার-এর অন্যতম অনুপ্রেরণাশক্তি। ইতিহাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে ‘যক্ষপুর’-এর আঁধার আজও কাটেনি, ‘মকররাজ’ নতুন চেহারায় ফিরে এসেছে বার বার। নতুন নতুন প্রতীকে, নতুন উপাখ্যান, নতুন লোভ নিয়ে।

এই মহামারির অস্থির, এলোমেলো সময়ে, যখন আমরা পরস্পরবিচ্ছিন্ন, তখন যেমন কামু-র ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসটির প্রতি আমাদের মনোযোগ আরও গভীর হয়েছে, তেমনই বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্রীমতী লিন্ডসে স্টোনব্রিজ আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন আরও এক কবির কথা। অস্ট্রিয়ায় জন্মানো সেই মহিলা কবি ইঙ্গেবোরগ বাকম্যান-এর মৃত্যু হয়েছিল ১৯৭৩ সালে, মাত্র ৪৩ বছর বয়সে। বাকম্যান যুদ্ধ দেখেছিলেন। দেখেছিলেন ফ্যাসিবাদের কুৎসিত রূপ। বাকম্যানের গদ্য কামু-র ভাষার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। দু’জনের কাছেই ‘লেখা’ বা ‘রচনা’ ছিল এক ঐতিহাসিক ও অস্তিত্ববাদী সংগ্রাম। তবু যখন মহামারিরূপে নানা অন্যায়, অবিচার নিষ্ঠুর ক্ষমতাদর্প আমাদের গ্রাস করে, আমাদের নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিতে চায়, তখন মানুষ পক্ষ অবলম্বন করার বিলাসিতা দেখাতে পারে না। সে তখন নিজের পক্ষ অবলম্বন করে— স্বার্থপর হয়ে নয়, আপস করে নয়। ‘সত্য’কে চিনতে পেরে, ধ্বংস ও মৃত্যুকে চিনতে পেরে, সে তার চোখে চোখ রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ইঙ্গেবোরগ বাকম্যান ছিলেন তেমন এক কবি। তাঁর লেখা ‘ম্যালিনা’ উপন্যাসে তিনি লেখেন— ‘মানুষ মরে না, তাদের নানা উপায়ে, নানা পন্থায় হত্যা করা হয়।’’

ক্ষমতা নানা সময়ে ব্যাধির মতো। দুরারোগ্য মহামারির মতো ছিবড়ে করে দিয়েছে আমাদের, এখনও দিচ্ছে। ঠিক এই মুহূর্তে, যখন আমরা বসে বসে ভাবছি এই বার সব ঠিক হয়ে যাবে, যখন কল্পনা করছি পর দিন সকালে উঠে দেখব সব আগের মতো, যত এই মিথ্যা, অলীক আশাবাদে স্থবির হয়ে থাকব, ততই শাসকের বাঁধন আরও শক্ত হবে। আমাদের সময়ে মহামারি এসেছে এমন এক সত্য হয়ে, যখন সমস্ত ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক রূপকগুলি এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। তাই ঠুনকো আশাবাদ নয়, পক্ষ অবলম্বন নয়, কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি অন্ধ আনুগত্যে নয়, নিজের সজাগ, স্বাধীন চিন্তায় ভর করে অন্ধকারকে অন্ধকার হিসেবে মেনে নিয়েই উঠে দাঁড়াতে বলেন সঙ্কটকালের কবি ইঙ্গেবোরগ বাকম্যান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন