কূটনীতিতে কবে সাবালক হব

দেশ স্বাধীন হওয়ার বছর আষ্টেক পর সোভিয়েত ইউনিয়নের দুই নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ এবং নিকোলাই বুলগানিন ভারত সফরে এসে জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। সেখানে জম্মু ও কাশ্মীরকে ভারতের অংশ হিসাবে তুলে ধরতে কোনও দ্বিধা না দেখালেও, যে সরকারি সোভিয়েত মানচিত্রটি বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদকে দেওয়া হয় তাতে অরুণাচল প্রদেশকে (তখন নেফা) চিনের অংশ হিসাবেই দেখানো ছিল।

Advertisement

রণেন সেন

শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share:

জগৎসভায়। জি-২০ গোষ্ঠীর সম্মেলনে। চিন, সেপ্টেম্বর ২০১৬। গেটি ইমেজেস

দেশ স্বাধীন হওয়ার বছর আষ্টেক পর সোভিয়েত ইউনিয়নের দুই নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ এবং নিকোলাই বুলগানিন ভারত সফরে এসে জম্মু ও কাশ্মীর নিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। সেখানে জম্মু ও কাশ্মীরকে ভারতের অংশ হিসাবে তুলে ধরতে কোনও দ্বিধা না দেখালেও, যে সরকারি সোভিয়েত মানচিত্রটি বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদকে দেওয়া হয় তাতে অরুণাচল প্রদেশকে (তখন নেফা) চিনের অংশ হিসাবেই দেখানো ছিল। এই নিয়ে ভারতের পক্ষ থেকে বার বার ‘ডিমার্শ’ বা কূটনৈতিক চেতাবনি দেওয়া সত্ত্বেও কোনও লাভ হয়নি সে সময়। এর বহু পরে ১৯৭৮-এ সোভিয়েত ইউনিয়ন নিতান্ত নিমরাজি হয়ে, কোনও মতে ম্যাকমেহন লাইনকে ভারত চিন সীমান্ত হিসাবে মেনে নেয় ঠিকই, কিন্তু আকসাই চিনকে চিনের অংশ হিসাবেই তাদের মানচিত্রে তুলে ধরে।

Advertisement

এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করার একটাই কারণ। আজ মস্কো আমাদের প্রতি পুরনো মিত্রতা ভুলে গিয়ে চিন বা পাকিস্তানের প্রতি বেশি ঝুঁকছে— এই মর্মে চার দিকে শোরগোল শুনতে পাচ্ছি। সকলেই যেন আকাশ থেকে পড়েছেন। কিন্তু রাষ্ট্রনীতির ওঠাপড়ার প্রতি সজাগ দৃষ্টি থাকলে এই ঘটনায় বিস্মিত হওয়ার বা আক্ষেপ করার কোনও কারণ আমি দেখছি না। যে কোনও দেশের কাছেই নিজের জাতীয় স্বার্থ মহামূল্যবান। সেই স্বার্থ কখন কী ভাবে রক্ষিত হবে সেটাও কোনও পূর্বনির্দিষ্ট ঘড়ি ধরে চলে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, আন্তর্জাতিক অর্থনীতির বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তা পাল্টে পাল্টে যেতে থাকে। দ্বিতীয়ত, সেই জাতীয় স্বার্থকে বাদ দিয়ে কোনও দেশই কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে যায় না। স্বার্থে ঘা লাগলে বন্ধুত্ব বদলে যেতেই পারে বৈরিতায়। পৃথিবীতে কোথাও কোনও ‘ফ্রি লাঞ্চ’ নেই! তা ছাড়া কোনও একটি দেশের সঙ্গে আর একটি দেশের মিত্রতা থাকলেও অন্য কোনও রাষ্ট্রের সঙ্গেও প্রথম দেশটির সখ্য থাকবে না— এমনটা ভাবা নির্বুদ্ধিতা।

যেমন ধরা যাক ভারতের কথা। শুধু পাক অধিকৃত কাশ্মীর নয়, গিলগিট এবং বালটিস্তানও মূল ভারতের ভূখণ্ডের অন্তর্গত, এমনটাই দাবি করে ভারত। আর এই দাবিকে স্বাভাবিক ভাবেই দেশবাসী স্বাগত জানিয়েছে। ভারতও আন্তর্জাতিক মহলে এই দাবিসনদ নিয়ে বক্তৃতার ঝড় তুলছে। বিভিন্ন বহুপাক্ষিক বৈঠকে (যেখানে পাকিস্তান নেই) পাকিস্তান নিয়ে কাঁদুনি গাইছে। চেষ্টা করছে, পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক বিশ্বে একঘরে করে দেওয়ার। কিন্তু কথা হল, আমাদের আবেগকে বা আমাদের আইনকে ক’টা দেশ সম্মান করে? বাস্তবটা স্বীকার করে নেওয়াই ভাল যে আসলে কেউই করে না! বেশির ভাগ দেশ, বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠী (যেখানে আমরা সদস্য), বিশ্বের বৃহৎ শক্তি— কেউই আমাদের মানচিত্র মেনে নেয়নি। ভবিষ্যতেও নেবে বলে মনে হয় না। আমরা এ বিষয়ে যে কূটনৈতিক সক্রিয়তা দেখাই তা অনেকটাই প্রতীকী। যার মধ্যে কোনও হাতে গরম ফলাফল পাওয়ার মতো শক্তি নেই। সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর নিয়ে আমাদের উদ্বেগের কথা। এই নিয়ে আমরা চিনকে যারপরনাই বুঝিয়েছি। বস্তুত, এই নিয়ে কোনও মঞ্চেই বলতে বাকি রাখিনি। এক বারও ভাবিনি যে এই নিয়ে অন্য কোনও প্রতিবেশী দেশের, বা সেই অর্থে কোনও বড় দেশেরই কিছু যায় আসে না। তারা চলে তাদের হিসাবে।

Advertisement

সন্ত্রাসবাদ যে ভারতের সার্বভৌমত্ব বিনাশ করার চেষ্টা করছে সেটা নিয়ে ইদানিং আন্তর্জাতিক ঐকমত্য তৈরি হচ্ছে। খুবই ভাল কথা। কিন্তু সেখানেও যথেষ্ট দ্বিচারিতা এবং মান্ধাতার আমলের মানসিকতা রয়েছে। সেগুলি যত দ্রুত মেরামত করা য়ায় ততই ভাল। এটাও আমাদের আশা করাটা বাড়াবাড়ি যে, পাকিস্তানের ক্ষমতাশালী সরকারের মানসিকতা বদল করার জন্য আমরা আন্তর্জাতিক শক্তিকে একজোট করতে সমর্থ হব। অথবা নিজেদের স্বার্থের দিকটি পাকিস্তানকে বোঝাতে সক্ষম হব।

ঘটনা হল, ঠান্ডা যুদ্ধের পর বিশ্ব ব্যবস্থা অনেকটাই বদলে গিয়েছে। আমেরিকা, রাশিয়া এবং চিন— এই তিনটি বৃহৎ শক্তিই কিন্তু ঘটনা এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী তাদের নীতি এবং দর্শন বদলাতে বদলাতে চলেছে। ঠান্ডা যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের লক্ষ্য ছিল আমেরিকার সমকক্ষ এক শক্তি তৈরি করা। চিনও সে সময় আমেরিকার দিকে ঝুঁকে রাশিয়ার বিরোধিতা করে গিয়েছে দিব্যি। সে ক্ষেত্রে তাদের তাত্ত্বিক আশ্রয় ছিল, চিনেরই এক বহু প্রাচীন নীতি। সেটা হল, ‘প্রতিবেশীর বিরোধিতা করতে সূদুরের রাষ্ট্রের হাত ধরা উচিত!’ কিন্তু মনে রাখতে হবে, বড় শক্তিগুলির নীতি কখনও অনড় নয়। ক্রমাগত নিজ নিজ (মূলত অর্থনৈতিক) স্বার্থের প্রেক্ষিতে তারা সেই নীতির বদল ঘটায়। কিন্তু আমরা নিজেদের নীতি বদলাতে গড়িমসি করতে থাকি। সরকারের পর সরকার আসে যায়, বিদেশ নীতিতে বড় বদল আসে না। পরিবর্তন কেউ করতে চাইলে বাধাও তৈরি করি। একবগ্গা হয়ে চলার ব্যাপারে গোঁ ধরে বসে থাকি।

ভারত মার্কিন পরমাণু চু্ক্তির বিষয়টিই ধরা যাক। এই ঐতিহাসিক চুক্তিটিকে আমরা প্রায় দেশপ্রেমের মানদণ্ডে পরিণত করে তার বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দিয়েছি। চুক্তি হয়েছে কিন্তু কিছুই এগোয়নি। অতি সম্প্রতি এ ব্যাপারে শক্ত গাঁট কিছুটা খুলেছে। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং দেশের সংশ্লিষ্ট সরবরাহকীররা। সে জন্য দেশের শীর্ষ নেতৃত্বকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। একই ভাবে ভারত-মার্কিন প্রতিরক্ষা চুক্তি ২০০৫ সালে হওয়া সত্ত্বেও বছরের পর বছর কিছুই এগোয়নি হাতে কলমে। আমরা কি সাবালক হব না এখনও?

বিশ্বজোড়া অর্থিক মন্দা এবং ক্রমবর্ধমান সামাজিক অস্থিরতার প্রশ্নে যে অসম বৃদ্ধি হচ্ছে তাতে ভুগতে হচ্ছে অনেক দেশকেই। এমতাবস্থায় বিশ্বায়ন এবং খোলা বাজারের প্রশ্নে প্রশাসনের গয়ংগচ্ছ ভাব কাটানো প্রয়োজন। জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও প্রতিশ্রুতিকে মেলানো প্রয়োজন। সর্বত্র বিভিন্ন দেশ তাদের জাতীয়, জাতিগত, ধর্মীয় ভাষাগত সত্তাকে নতুন করে আবিষ্কার করছে। তাকে সামনে নিয়ে আসছে। অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তালসঙ্গত করছে নিজেদের প্রয়োজন বুঝে। অতীতের বোঝাকে কাঁধে না চাপিয়ে। দুর্ভাগ্যবশত, আমরা এবং আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র— কেউই এখনও এই প্রবণতার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারছি না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের ভূতপূর্ব রাষ্ট্রদূত
(অগস্ট ২০০৪ — মার্চ ২০০৯)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন