মেরু অভিযানে ভারত কই

উত্তরমেরু অঞ্চলের নৈসর্গিক রূপ ও জীববৈচিত্র এতই আলাদা যে জনবহুল শহর-মফস্সলের সঙ্গে তার সম্পর্ক কল্পনা করা কঠিন। কিন্তু সংযোগ নিবিড়।

Advertisement

জয়ন্ত রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০১
Share:

পৃথিবী খুব ছোট, মানুষে-মানুষে সম্পর্কের নিরিখে সে কথাটা অনেক দিনই বোঝা গিয়েছে। কিন্তু বিপুলা এ পৃথিবীর দূরতম দুই মেরুর সঙ্গে হিমালয়ের অদৃশ্য সংযোগ যে ভারতীয়দের জীবনদাত্রী বর্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করে, এই উপলব্ধিটা একেবারেই আধুনিক। গত বছর দুই ভারতীয় বিজ্ঞানী আর্কটিক মহাসাগরের তাপমাত্রার পরিবর্তন-প্রবণতা সম্বন্ধে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। সমুদ্রের তলার মাটির নমুনার বিশ্লেষণ থেকে জানা যাচ্ছে, গত দু’শো বছরে আর্কটিকের তাপমাত্রা একটু একটু করে বেড়েছে। কিন্তু ১৯৭০ থেকে বাড়ার হার দ্রুততর হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, আর্কটিক বা মেরু অঞ্চলের তাপমাত্রা বাড়ার প্রবণতা বাকি পৃথিবীর দ্বিগুণ। ফলে হিমবাহ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে।

Advertisement

এতে ভারতীয়দের দুশ্চিন্তার যথেষ্ট কারণ আছে। উত্তরমেরু অঞ্চলের নৈসর্গিক রূপ ও জীববৈচিত্র এতই আলাদা যে জনবহুল শহর-মফস্সলের সঙ্গে তার সম্পর্ক কল্পনা করা কঠিন। কিন্তু সংযোগ নিবিড়। উত্তরমেরুর বরফ-গলা জল দক্ষিণের সমুদ্রে পৌঁছয়। সেই শীতল স্রোত উষ্ণ উপকূলের সংস্পর্শে এসে বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বাড়ায়। এই জলপূর্ণ বায়ু হিমালয়ের সংস্পর্শে আসার পর নানা প্রক্রিয়ায় পরিবর্তিত হতে হতে শেষে বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে। সেই উষ্ণ জল সমুদ্রস্রোতে মিশে আর্কটিক মহাসাগরে ফেরে। উত্তরাখণ্ড বা কাশ্মীরে যদি প্রবল বৃষ্টি হয়, তার দুই সপ্তাহের মধ্যেই উত্তরমেরুর বরফ গলার হার বেড়ে যায়। আবার, ভারতের গমচাষিরা শীতে যে বৃষ্টিপাতের জন্য প্রতীক্ষা করে থাকেন, তাতেও উত্তরমেরুর অবদান আছে। মেরুর ঠান্ডা হাওয়া ইউক্রেনের বায়ুমণ্ডলের গরম, জলসিঞ্চিত হাওয়ার সংস্পর্শে এলে নিম্নচাপ তৈরি হয় উচ্চ বায়ুমণ্ডলে। দ্রুতবেগে এসে সেই হাওয়া আছড়ে পড়ে হিমালয়ে। পাহাড়ে তুষারপাত হয়, নিম্নাঞ্চলে বৃষ্টি। পুষ্ট হয় গম। আবার অতিবর্ষণে পাহাড়ে ধস নামে ও বন্যা হয়।

ধ্রুবতারার ঠিক নীচে যে পৃথিবী, আর্কটিক মহাসাগর আর তার উপকূলবর্তী কানাডা, আলাস্কা, সাইবেরিয়া, নরওয়ে ও গ্রিনল্যান্ড নিয়ে আর্কটিক অঞ্চল। এ ছাড়া আছে কয়েকটি ছোট ছোট দ্বীপপুঞ্জ, যেমন সোয়ালবার্ড। অনেক দেশ দিয়ে ঘেরা থাকা সত্ত্বেও বিশ শতকের আগে উত্তরমেরু সম্বন্ধে কমই জানা ছিল। বহু পর্যটক উত্তরমেরুর সন্ধানে গিয়ে বিফল হয়েছেন, প্রাণও দিয়েছেন। ১৯৬৯ সালে মানুষ চাঁদে পা রেখেছিলেন, সে বছরই কুকুর-টানা স্লে-র সাহায্যে মানুষ প্রথম উত্তরমেরুতে পৌঁছন। শুধু অ্যাডভেঞ্চারের আকর্ষণ নয়, বিশ্ব-উষ্ণায়নের হার মাপার তাগিদেও আর্কটিকে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।

Advertisement

সোয়ালবার্ড-এর বৃহত্তম দ্বীপ স্পিটজ়বার্গেন। সারা বছর এখানে থাকে মেরুভল্লুক, আর্কটিক শিয়াল, বল্গাহরিণ। জলে থাকে দাঁতাল সিন্ধুঘোটক আর নানা জাতের সিল। গ্রীষ্মে আসে নানা প্রজাতির লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী পাখি। সমুদ্র থেকে খাড়াই উঠে যাওয়া পাহাড়ে তাদের বাসা। দ্বীপের এক দিকে পাহাড়ের ঢালে মাটির গায়ে রং-বেরঙের তুন্দ্রা গুল্ম (লাইকেন), অন্য দিকে পাহাড় থেকে সমুদ্র পর্যন্ত নেমে আসা হিমবাহ। তা থেকে বজ্রগর্জনে সমুদ্রের উপর ভেঙে পড়ে হিমানি-সম্পাত। জাহাজে দু’শো কিলোমিটার উত্তরে গেলেই দেড় মিটার পর্যন্ত গভীর, দুর্ভেদ্য নিবিড়-সন্নিবিষ্ট সামুদ্রিক বরফ। অনেকে আর্কটিককে বলেন ‘তুষার স্বর্গ’।

সেই স্বর্গে আজ দুর্যোগ। স্পিটজ়বার্গেন-এর যে সব জায়গা দুই দশক আগেও গ্রীষ্মে বরফঢাকা থাকত, এখন সেখানে রুক্ষ পাথর। আগে শীতকালে তুষার গলত না, পায়ের খুর দিয়ে সেই নরম তুষার খুঁড়ে বল্গাহরিণেরা তুন্দ্রা-গুল্ম খেত। এখন তাপমাত্রা বেড়ে যাওযায় তুষার পর্যায়ক্রমে গলে ও আবার জমে যায়। তাতে কঠিন বরফ তৈরি হয়, বল্গাহরিণরা যা খুঁড়তে পারে না। তাদের ওজন ও প্রজনন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। নিসর্গবিজ্ঞানীদের মডেল বলছে, এই শতকের শেষে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর উত্তরমেরুতে সামুদ্রিক বরফ অবশিষ্ট থাকবে না।

আর্কটিক প্রাণীদের বিলুপ্তি রোধের চেষ্টা চলছে। আর্কটিক অঞ্চলের দেশগুলিতে চর্বি ও দাঁতের জন্য নির্বিচার প্রাণী-হত্যা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। ওয়ালরাস সংখ্যায় বাড়ছে, আর্কটিক শিয়ালও আপাতত বিপন্মুক্ত। কিন্তু কয়েক দশক পরে যদি উত্তরমেরুর বরফ শেষ হয়ে যায়, এরা বাঁচবে কী করে? এই বিচিত্র প্রাণীদের বাঁচানোর দায়িত্ব সব দেশের। ভারতও সে কাজের অংশিদার। ২০১৮ সালে ভারতের ‘জাতীয় অ্যান্টার্কটিক ও মহাসাগরীয় গবেষণা কেন্দ্র’-‌এর নতুন নামকরণ হয়েছে জাতীয় মেরু ও মহাসাগরীয় গবেষণা কেন্দ্র (ন্যাশনাল সেন্টার ফর পোলার অ্যান্ড ওশন রিসার্চ)। স্পিটজ়বার্গেন দ্বীপের পশ্চিমে ২০০৮ সালে ভারতের আর্কটিক গবেষণা কেন্দ্র ‘হিমাদ্রি’-র উদ্বোধন হয়েছে। নরওয়ের সহযোগিতায় ভারতীয় বিজ্ঞানীরা হিমবাহের ভারসাম্য, জীববৈচিত্রের উপর উষ্ণায়নের প্রভাব বিষয়ে গবেষণা করছেন। কিন্তু ভারতের নিজস্ব গবেষণা জাহাজ নেই। ভাড়া জাহাজ।

আর্কটিক-গবেষণায় ভারত যতই সক্রিয় হোক, চিন এতে দশ গুণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে, অনেক বেশি বিজ্ঞানীকে নিয়োগ করেছে। এই বছর জার্মানির নেতৃত্বে বড় মাপের আর্কটিক অভিযান হবে। নানা দেশের শতাধিক বিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি গবেষণা-পোত গ্রীষ্মের শেষে উত্তরমেরু যাবে। শীতে সমুদ্র জমে জাহাজ তুষারবন্দি হয়ে গেলে চিন ও রাশিয়ার বরফ-ভাঙা জাহাজ তাদের তেল ও খাদ্য জোগাবে। ইতিহাসের বৃহত্তম এই ভাসমান গবেষণা কেন্দ্রে বিজ্ঞানীদের সমবেত উদ্যোগে হয়তো উত্তরমেরুর অনেকটাই জানা যাবে। দুঃখের কথা, ভারত এই অভিযানে অংশ গ্রহণ করছে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন