প্রতীকী ছবি।
আশঙ্কার চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে পরিস্থিতি। ‘ছেলেধরা’ গুজব আবার প্রাণ নিল। এ বার কর্নাটকে। অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে কর্নাটকে বেড়াতে গিয়েছিলেন চার জন। গণপ্রহারকারীদের হাত থেকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাঁদের উদ্ধার করে পুলিশ। এক জনের মৃত্যু হয়েছে, তিন জন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। আর কত? কোথায় গিয়ে থামবে সংখ্যাটা? কী ভাবেই বা রোখা যাবে এই মারণ গুজব? অবিলম্বে এই প্রশ্নগুলোর জবাব খোঁজা জরুরি।
কর্নাটকে যাঁর প্রাণ গেল গণপ্রহারে, তিনি ইঞ্জিনিয়ার। বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত ছিলেন। সাজপোশাক, কথাবার্তা, আদবকায়দা— কোনও কিছুতেই ছেলেধরা মনে হয় না তাঁকে বা তাঁর সঙ্গীদের দেখলে। কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপে ছড়াতে থাকা নানা গুজব এতটাই ভয়ঙ্কর করে তুলেছে পরিস্থিতি যে, কাকে দেখে কার মনে কখন কী ধরনের সংশয়ের উদ্রেক হয়, বলা কঠিন। গোটা দেশে যেন একই প্রবণতা। কখনও উত্তর-পূর্ব ভারতে, কখনও সুদূর দক্ষিণে, কখনও মহারাষ্ট্রে— ভারতের প্রায় সব অংশে দাবানলের মতো ছড়িয়েছে ‘ছেলেধরা’ গুজব। প্রশাসন সজাগ হয়ে ওঠার পরেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।
কেন্দ্রীয় সরকার শুরুতেই কঠোর পদক্ষেপ করেছে, গোয়েন্দারা সক্রিয় হয়েছে। ভয়ঙ্কর গুজব ছড়ানো রোখার দায় হোয়াটসঅ্যাপ বা সংশ্লিষ্ট সোশ্যাল মিডিয়াগুলিরও রয়েছে— সংস্থাগুলিকে স্পষ্ট জানিয়েছে ভারত সরকার। দ্রুত পদক্ষেপ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ। কিন্তু গুজব থামেনি। প্ররোচনামূলক রটনার ক্ষেত্রে সত্য-মিথ্যার প্রভেদ করার উপায় এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। অতএব মৃত্যুর মিছিল অব্যাহত।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
আরও পড়ুন: ছেলেধরা সন্দেহে কর্নাটকে গুগলের ইঞ্জিনিয়ারকে পিটিয়ে খুন
যা ঘটছে তা মর্মান্তিক এবং ভয়ঙ্কর তো বটেই। এতে গভীর ষড়যন্ত্রের আভাসও রয়েছে। দেশের সবক’টি প্রান্তে একই রকম গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, সর্বত্র একই ভাবে হামলাগুলো হচ্ছে। প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পক্ষ বার বার সতর্কতা জারি করা সত্ত্বেও পরিস্থিতি কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এ ছবি ভয়ঙ্কর তো বটেই, এ ছবি বেশ জটিলও। কোনও সোজাসাপ্টা কারণে হু হু করে মারণ গুজবটা ছড়াচ্ছে, এমনটা নাও হতে পারে। এর নেপথ্যে কোনও জটিল-কূটিল নকশার অস্তিত্ব থাকতে পারে।
কারা তৈরি করছে সে নকশা? ষড়যন্ত্রী কারা? ভারত জুড়ে অশান্তি, অস্থিরতা, অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি করে রাখা যে সব শক্তির লক্ষ্য, এই মারণ গুজবের পিছনে তাদের হাত থাকতে পারে। গোটা ভারতে যদি অস্থিরতা ছড়িয়ে দেওয়া যায়, ভারতীয় সমাজে যদি পারস্পরিক অবিশ্বাসের পরিমণ্ডল তৈরি করা যায়, বিপুল বৈচিত্রের একটা জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিয়ে যদি অভ্যন্তরীণ টানাপড়েন উস্কে দেওয়া যায়, তা হলে কাদের লাভ? ভাবতে হবে আমাদের প্রত্যেককেই।
সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ তো করতেই হবে। সোশ্যাল মিডিয়া কর্তৃপক্ষকেও বিভ্রান্তি রোখার দায় নিতে হবে। কিন্তু ‘ফেক নিউজ’ আর ‘পোস্ট ট্রুথ’-এর এই যুগে খবর আর গুজবের ফারাক খুঁজে বার করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই প্রত্যেক নাগরিককেও নিজের নিজের দায়িত্ব বুঝে নিতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে, সতর্ক রাখতে হবে, চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। প্রত্যেককে ভাবতে হবে যে, আমরা যে কেউ, যে কোনও দিন, যে কোনও পরিস্থিতিতে এই গুজবের শিকার হয়ে যেতে পারি। অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা যে বাইরের থেকেও হতে পারে, তা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। না হলে পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা রয়েছে।