এই তো সবে শুরু

এহেন অসহযোগিতার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বলতে গিয়ে শিক্ষাবিদ মালিনী ভট্টাচার্য স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘‘এই সরকারের আমলে হিউম্যানিটিজ গবেষণার ব্যয়বরাদ্দ অনেকটাই সংকুচিত করা হচ্ছে।

Advertisement

শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৭ ০৬:০০
Share:

প্রতিবাদী: মানবীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্রকে অনুদান বন্ধের প্রতিবাদে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সভা। সৌজন্য: মানবীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্র, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

অশনিসংকেত পাওয়া যাচ্ছিল কয়েক মাস আগে থেকেই। অবশেষে ইউজিসি-র (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন) কুঠারাঘাত নেমে এল গত ৯ জুন। একটি সংক্ষিপ্ত জনবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হল যে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্রকে ৩০ সেপ্টেম্বরের পর থেকে আর আর্থিক অনুদান দেওয়া হবে না। এই সিদ্ধান্তের পরিণামে চাকরি হারাবেন আট জন শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী। শুধু যাদবপুর নয়, রাজ্য এবং দেশের বহু অন্যান্য মানবীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্রও অনুরূপ সংকটের সম্মুখীন। বিজ্ঞপ্তিতে অবশ্য বলা আছে যে, ভবিষ্যতের অনুদান নির্ভর করবে অ্যাকাডেমিক কাজের ঠিক মূল্যায়নের ওপর, যদিও কারা মূল্যায়ন করবে এবং কবে করবে, সে বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি।

Advertisement

এহেন অসহযোগিতার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বলতে গিয়ে শিক্ষাবিদ মালিনী ভট্টাচার্য স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘‘এই সরকারের আমলে হিউম্যানিটিজ গবেষণার ব্যয়বরাদ্দ অনেকটাই সংকুচিত করা হচ্ছে। সামাজিক ন্যায়চর্চার সঙ্গে যুক্ত বেশ কয়েকটি শিক্ষাকেন্দ্রকে অনুদান প্রদানও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এমনকী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও দর্শন বিভাগগুলি ঘোর আর্থিক সংকটে পড়েছে। এই অব্যবস্থার সুযোগ নিচ্ছে কিছু কোচিং সেন্টার, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্রান্ত তকমা এঁটে ইতিহাস ও দর্শন পড়াচ্ছে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে। এই সমগ্র পরিকল্পনার ও প্রক্রিয়ার লক্ষ্য হল উচ্চশিক্ষার বাজারিকরণ ও বেসরকারিকরণ।’’ এ প্রসঙ্গে যে কথাটা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য, তা হল, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তা কোনও তাৎক্ষণিক ভিক্ষার ব্যাপার নয়। জোরালো দাবি পেশ করেই মালিনী ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘নির্দিষ্ট নীতি ও পরিকল্পনা অনুযায়ী উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলিকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা করা কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলির দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।’’

কিন্তু ইউজিসি বা বকলমে কেন্দ্রীয় সরকার এই কঠোর পদক্ষেপ করছে কেন? কারণটা কি শোচনীয় অর্থাভাব, মতাদর্শের ভীষণ চাপ, না নিছকই গৈরিক খেয়ালিপনা? এই মূল, অপরিহার্য প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সুপ্রিয়া চৌধুরী বলেন, ‘‘এ তো সবে শুরু বা সূচনা। আমার এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, এই আক্রমণ বা অসহযোগিতা পরবর্তী কালে হিউম্যানিটিজ-এর অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য বিষয় এবং অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বা প্রোগ্রামের ওপরেও নেমে আসবে। আরও স্পষ্ট করে বললে, যে শিক্ষণীয় বিষয়গুলির অঙ্গাঙ্গি যোগ থাকবে বা আছে মানবাধিকারের সঙ্গে, ন্যায়বিচারের সঙ্গে, সাম্য বা সমানাধিকারের সঙ্গে, সেগুলিকে কেন্দ্রীয় সরকার আর আর্থিক অনুদান দেবে না। অর্থাৎ, এই সমগ্র অসহযোগিতার পিছনে সক্রিয় একটি ঘোর পশ্চাদ্‌গামী মতাদর্শ যা মুক্তচিন্তা ও সৃজনশীল ভাবনা, প্রগতিমুখী চেতনা ও যুক্তিনির্ভর শিক্ষাদানের পরিপন্থী।’’ স্পষ্টতই, মালিনী ভট্টাচার্য ও সুপ্রিয়া চৌধুরী পরোক্ষে গৈরিক মতাদর্শের তীক্ষ্ণ সমালোচনা করেছেন, যার লক্ষ্যই হল এক-একটি চেতনাহীন রোবট বা মডিউল তৈরি করা, যে রোবট ‘তাসের দেশ’-এর পাত্রপাত্রীর মতো উঠতে বললে উঠবে, বসতে বললে বসবে।

Advertisement

সত্যি বলতে, সে দিনের আগমন সম্ভবত আসন্ন, যে দিন দেশের উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রগুলি শুধুমাত্র ফলিত প্রযুক্তি (অ্যাপ্লায়েড টেকনলজি) এবং ব্যবসা পরিচালনবিদ্যার (বিজনেস ম্যানেজমেন্ট) ওপরেই জোর দেবে। ইতিহাস যদি বা পড়ানো হয়, পড়ানো হবে গৈরিক ইতিহাস, যা কিনা প্রকৃত ইতিহাসের বিরোধী। এই গৈরিক ইতিহাসই সাভারকরের মতো প্রশ্নাকীর্ণ মানুষকে নির্ভেজাল দেশপ্রেমিক বলে গণ্য করে। অন্য ভাবে বলতে গেলে, এ দেশের বিদ্যায়তনগুলিতে দূরদর্শী ও যুক্তিনিষ্ঠের কোনও জায়গা থাকবে না।

বেশ কয়েক জন শিক্ষাবিদ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকার মানবীবিদ্যাচর্চার পরিবর্তে পারিবারিক বিদ্যাচর্চার প্রবর্তন ঘটাতে চায়। বিজেপি সরকার সেই নব্বইয়ের দশকে এ বিষয়টি বা বিষয়ের পরিবর্তন নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করে। সৌভাগ্যক্রমে, পরবর্তী কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার এ ব্যাপারে কোনও অগ্রপদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত ছিল। বর্তমান শাসকেরা সম্ভবত পুরনো এই দাবি আবার পেশ করবেন। খুব কম করে বললেও, এই পারিবারিক শিক্ষাক্রম ঘোর প্রতিক্রিয়াশীল এবং পশ্চাদ্‌মুখী। এর প্রধান লক্ষ্যই হবে মহিলাদের পুনরায় রন্ধনশালায় প্রেরণ এবং অক্লান্ত নামসংকীর্তনে তাঁদের কণ্ঠদান। এক কথায়, এই পারিবারিক শিক্ষাক্রম বা ফ্যামিলি স্টাডি নারীকে আবার পরিণত করবে গৃহ প্রতিপালন ও সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে। এই বিষয়ে শিক্ষাবিদ সুদেষ্ণা চক্রবর্তী বলেছেন, ‘‘এর থেকে বড় বিয়োগান্ত পরিণতি কল্পনা করা যায় না। গত চল্লিশ বছর ধরে দেশের শতাধিক মানবীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্র যে প্রগতির পথ সুনির্দিষ্ট ও সুনিশ্চিত করেছে, তা কলমের এক খোঁচায় গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে এবং নারীরা ফিরে যাবে সেই মধ্যযুগে।’’

সম্ভাব্য পরিণতি নিঃসন্দেহে বিয়োগান্ত। কিন্তু তা রোধ করা যায় কী করে? প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের একটা নকশা বা পরিকল্পনা তৈরি করার জন্য গত শুক্রবার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কনভেনশন-এর আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন মানবীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের প্রতিনিধিরা এই আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করেন এবং একটি ত্রিস্তরীয় কার্যক্রমের রূপরেখা তৈরি করেন। প্রথমে আবেদন জানানো হবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে, বিশেষ করে উপাচার্যকে। দ্বিতীয় স্তরে রাজ্য সরকারকে অনুরোধ করা হবে এই সংকট নিরসনের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ করতে। এবং শেষে কেন্দ্রীয় সরকার তথা ইউজিসি-কে বলা হবে পক্ষপাতদুষ্ট ও ঘোরতর অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ না করতে। আশার কথা, উপাচার্য সুরঞ্জন দাস, ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং মুখ্যমন্ত্রী তাঁর দিক থেকে আশ্বাসের বাণী উচ্চারণ করেছেন।

এই প্রতিবাদের একটি রূপরেখা অঙ্কন করতে গিয়ে মানবীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের বর্তমান পরিচালক শমিতা সেন দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, ‘‘আমি স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই যে, আমাদের কেন্দ্র অটুট ও অক্ষয় থাকবে। অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে গত চল্লিশ বছর ধরে আমরা তিলে তিলে এই বিদ্যাচর্চা কেন্দ্র গড়ে তুলেছি। কেন্দ্রীয় সরকার যদি অনুদান বন্ধও করে দেয়, আমরা বিকল্প পথের সন্ধান করব। এ প্রসঙ্গেই আমি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসবাণীকে স্বাগত জানাচ্ছি। যদি রাজ্য সরকার আমাদের অনুদান দেয়, আমরা এই মুহূর্তের সংকট মোচন করতে পারব।’’

প্রতিরোধের অবশ্যই প্রয়োজন আছে এবং এখন থেকেই। কারণ তা না হলে সেই দিনের আর বেশি দেরি নেই যে দিন বিদ্যাসাগরকে ব্রাত্য করা হবে তিনি সংশয়বাদী ছিলেন বলে, এবং মেঘনাদবধ কাব্যকেও পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া হবে, কেন না মাইকেল শ্রীরামকে পুরুষোত্তমের শিরোপা দেননি।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের প্রাক্তন ফেলো

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন