সম্পাদকীয় ১

উদ্‌যাপন

‘আমিও’ এবং ‘সময় ফুরাইয়াছে’— এই দুই দাবি টুইটার ও ফেসবুকে শুরু হইয়া সমাজ-সংসার, অর্থনীতি-রাজনীতিতে ঝড় তুলিয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৮ ০০:১৯
Share:

তর্ক বুঝি ফুরাইল। নারী দিবস উদ্‌যাপন কেন, ২০১৮ সালে তাহা স্পষ্ট। নারী আন্দোলন সত্যই বিশ্বায়িত। তাহার দীপ্ত ও দৃপ্ত প্রতিবাদের সম্মুখে বিশ্বের পুরুষতন্ত্রের প্রবল দ্বাররক্ষীরাও নতজানু। মার্কিন সেনেটর হইতে ব্রিটেনের ক্যাবিনেট মন্ত্রী, হলিউডের চিত্রতারকা হইতে বেজিংয়ের অধ্যাপক, কানাডার পার্লামেন্ট সদস্য হইতে দক্ষিণ কোরিয়ার জনপ্রতিনিধি— মহিলাদের প্রতি দুর্ব্যবহারের অভিযোগের সম্মুখে পদত্যাগ করিয়াছেন অগণিত শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি। রাজনৈতিক প্রভাব ও আর্থিক প্রতিপত্তির প্রাবল্যের জন্য যাহাদের অপরাজেয় বলিয়া মনে করা হইয়াছিল, কেবল সত্যভাষণের সাহস দিয়া মেয়েরা তাহাদের পরাহত করিয়াছে। ক্ষতিগ্রস্ত, পরিত্যক্ত, কলঙ্কিত হইবার ভয়কে জয় করিয়া মেয়েরা যে সাহসের পরিচয় দিয়াছে, বৃহত্তর সমাজ তাহাতে সাড়া না দিয়া পারে নাই। জনমতের চাপে অভিযুক্তদের সরিতে হইয়াছে। তাচ্ছিল্য করিয়া, রাজনৈতিক বিরোধিতার অজুহাত দেখাইয়া, মামলা করিবার ভয় দেখাইয়া কেহ এড়াইতে পারে নাই। সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করিয়া বিশ্বব্যাপী যে আন্দোলন ছড়াইয়াছে, তাহাতে পুরুষতন্ত্রের সুযোগসন্ধানী, নীচ, ঘৃণ্য রূপটি নিরাবরণ। হলিউডের মহিলা চিত্রতারকারা বিভিন্ন পুরস্কার অনুষ্ঠানকে ব্যবহার করিয়া নির্যাতন ও যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে নারী-ঐক্যের বার্তা দিয়াছেন। ব্রাজিলের কার্নিভালে মহিলারা নির্যাতন-বিরোধী গান গাহিয়াছেন। চিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা সরকারের রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করিয়া ‘আমিও লাঞ্ছিত’ বক্তব্যে স্বাক্ষর করিয়াছেন। কোনও রাজনৈতিক আন্দোলন এতগুলি দেশে এত সমর্থন পাইয়াছে কি?

Advertisement

‘আমিও’ এবং ‘সময় ফুরাইয়াছে’— এই দুই দাবি টুইটার ও ফেসবুকে শুরু হইয়া সমাজ-সংসার, অর্থনীতি-রাজনীতিতে ঝড় তুলিয়াছে। প্রতিবাদের প্রকাশটি লক্ষণীয়। বিংশ শতাব্দীতে ঐক্য দেখাইতে, আন্দোলনের জোর প্রকাশ করিতে মিছিল, ধর্মঘট করিতে হইত। তাহাকে ঠেকাইবার উপায়ও রাষ্ট্র ক্রমশ রপ্ত করিয়াছিল। এই একবিংশে প্রধান অস্ত্র সোশ্যাল মিডিয়া। টুইটার বা ফেসবুকে পরস্পরকে সমর্থন করিয়া মেয়েরা কণ্ঠরোধের সকল প্রচেষ্টাকে তুচ্ছ করিয়া সকল অনুশাসন লঙ্ঘন করিতে একে অপরকে সাহায্য করিয়াছে, সাহস জুগাইয়াছে। ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন সংস্কৃতির মেয়েরাও যে পুরুষতন্ত্রের নিকট সমান ভাবে লাঞ্ছিত, তাহার বোধ এই ভাবেই জাগিয়াছে। এত বিস্তৃত, বিচিত্র, বহুমুখী হইয়া দেখা দিয়াছে নির্যাতন-বিরোধী, মর্যাদা-প্রত্যাশী নারী আন্দোলন, এত প্রতিধ্বনি উঠিয়াছে দেশ হইতে দেশে, যে ধমক দিয়া চুপ করাইবার, লজ্জা দিবার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছে। হাজার-হাজার মেয়ে ঘর হারাইবার, কাজ হারাইবার, সম্মান হারাইবার ভয়ে যৌননিগ্রহ সহিতেছে। প্রতিটি মেয়ে ইহাকে কেবল তাহারই দুর্ভাগ্য মনে করিয়া মানিয়া লইতেছে। পরস্পর-সংযোগে তাহাদের সংকোচ দূর হইল।

অতঃপর? যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সবে শুরু হইয়াছে, তাহার পথ এখনও বাকি। অপর একটি প্রতিবাদেরও সূচনা হইয়াছে এই বৎসর। তাহা কর্মক্ষেত্রে অসাম্যের প্রতিবাদ। ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থার একশো সত্তর জন মহিলা সাংবাদিক ও প্রযোজক সমান কাজের জন্য সমান বেতনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করিয়াছেন। এক সাংবাদিক কম বেতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাইয়া পদত্যাগ করিবার পর আন্দোলন আরও তীব্র হইয়াছে। সংস্থাটি বাধ্য হইয়াছে স্বতন্ত্র সংস্থা দিয়া বেতনবিন্যাসের মূল্যায়ন করাইতে। নারীর অমর্যাদা তাহার দেহ ও শ্রম, উভয়ের অমর্যাদার উপরে দাঁড়াইয়া আছে। নারী আন্দোলনকে এই দুইয়েরই প্রতিকার দাবি করিতে হইবে। তাহা প্রতিদিনের কাজ। নারী দিবস সেই কঠোর প্রচেষ্টার মধুর উদ্‌যাপন।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন