এই নীচ মনোবৃত্তি ইংরাজ দেখাচ্ছে— তারা কালা আদমির সঙ্গে একত্রে মাঠে খেলতে নামবে না, আর আমিও প্রতিজ্ঞা করেছি, খুব শীঘ্রই তাদের ‘শেক হ্যান্ড’ করে আমাদের সঙ্গে খেলতে হবেই। খেলার মাঠে সকলকে একসঙ্গে দাঁড় করাব, একসঙ্গে খেলব, একসঙ্গে মিশব, আমাদের সংগঠনে নীচতার স্থান নেই, স্থান হবে কৃতিত্বের, সাহসের, নৈপুণ্যের।
— আজ থেকে একশো বছরেরও বেশি আগে কথাগুলো বলেছিলেন ভারতীয় ফুটবলের প্রথম কিক-অফ করা নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী। পরাধীন ভারতবর্ষে ফুটবল খেলার প্রচলনে এ সব বাধাবিপত্তির মুখে পড়তে হয়েছিল, সেটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এত কাল পরেও ফুটবল বিশ্বে ফিফাকে প্রচার করতে হচ্ছে: ‘কিক ইট আউট’। অর্থাৎ সাদা-কালোর বিভেদ দূর করো। বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে ফুটবল বিশ্বকে এখনও লড়তে হচ্ছে! ২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপে অন্য অনেক আকর্ষণ, আলোর রোশনাইয়ের মাঝেও তাই নজর থাকছে বর্ণবৈষম্যের মতো সমস্যা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে কি না তার উপর।
ফিফা দীর্ঘ দিন ধরেই প্রচার করে চলেছে ফুটবল থেকে বর্ণবিদ্বেষ দূর করার জন্য। ‘কিক ইট আউট’ প্রচার সাফল্যও পেয়েছে, ইংল্যান্ডের মতো দেশে কালো চামড়ার খেলোয়াড়দের অসম্মান করার প্রবণতা বন্ধ হয়েছে, কিন্তু ইউরোপের অনেক দেশেই এখনও রং নিয়ে মানুষকে অপমান করা হয়, বা পরোক্ষে হেয় করা হয়। বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশই বর্ণবিদ্বেষের বেড়াজাল থেকে এখনও বেরিয়ে আসতে পারেনি। আশঙ্কা আছে রাশিয়াকে নিয়েও।
সাত বছর আগে রাশিয়ার লোকোমোটিভ মস্কো ক্লাব পিটার ওডেমউইঙ্গি নামে কৃষ্ণাঙ্গ স্ট্রাইকারকে ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট ব্রমিচ অ্যালবিয়ন ক্লাবের কাছে বিক্রি করার সময় ‘ব্যনানা থিমড’ ব্যানার ঝোলানো হয়েছিল। রাশিয়ায় ‘টু গেট আ ব্যনানা’ শব্দবন্ধটি আসলে বিস্বাদ তথা সর্বস্বান্ত হওয়াকেই বোঝায়। এ তো তা-ও ব্যানার, কিছু দিন আগেই উয়েফা ইয়ুথ লিগের খেলায় লিভারপুলের স্ট্রাইকার রিয়ান ব্রুস্টারকে স্পার্টাক মস্কো ক্লাবের খেলোয়াড় লিয়োনিদ মিরোনভ–এর কাছে প্রকাশ্যে বর্ণবিদ্বেষমূলক মন্তব্য এবং আচরণের শিকার হতে হয়। ব্রাজ়িলিয়ান ফরোয়ার্ড হাল্ক রাশিয়ার জেনিট–এ খেলতেন, তাঁরও অভিজ্ঞতা— ওই দেশে বর্ণবিদ্বেষের সমস্যা প্রবল।
বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে এত প্রচার, ফিফার আলাদা করে প্রস্তাব গ্রহণ— এগুলো যত গর্জেছে খাতায় কলমে, মাঠে বা গ্যালারিতে তার প্রভাব পড়েনি কেন? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে ফিফা তথা বিভিন্ন দেশের ফুটবল কর্তৃপক্ষ কিছুতেই দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। বিগত বছরগুলিতে রুটিন প্রচার করে যাওয়া ছাড়া বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে এঁদের কোনও কঠোর পদক্ষেপ করতে দেখা যায়নি। পূর্ব ইউরোপের উগ্র বর্ণবিদ্বেষী ফ্যানদের বিরুদ্ধেও কোনও ব্যবস্থাই করা হয়নি। এমনকি বেশ কিছু সময়ে কর্তৃপক্ষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে বর্ণবাদীদের সমর্থন করে গিয়েছেন। সার্বিয়ার বিরুদ্ধে অনূর্ধ্ব একুশ খেলায় বর্ণবাদের প্রতিবাদ করায় ড্যানি রোসকে খেলা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। যা বর্ণবাদকেই স্বীকৃতি দিয়েছে। এ বার রাশিয়ায় থাকছে পাঁচটা আফ্রিকান দেশ, থাকছেন বহু দেশের কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়রা, থাকছেন নানান বর্ণের, চেহারার, ভাষার আরও অজস্র ফুটবলার। ওত পেতে থাকবে বর্ণবিদ্বেষের ভূত, ইতিমধ্যেই ফিফা এই নিয়ে সতর্ক।
রাশিয়া এবং ফিফার সামনে বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন করার পাশাপাশি বিশেষ ভাবে সজাগ থাকার দায়িত্ব— খেলার মাঠে বা গ্যালারিতে কোথাও যদি কোনও বর্ণবাদীর দাঁতনখ বেরিয়ে আসে, তাকে চিরতরে নির্বাসিত করা। কেবল মৌখিক প্রচার নয়, কার্যকর পদক্ষেপ না করলে এত বড় সমস্যা মিটে যাওয়ার নয়। যত দিন না ফিফা অবাঞ্ছিত ঘটনাগুলি ঘটার সঙ্গে সঙ্গে উপযুক্ত ব্যবস্থা না করছে, সোজা কথায় যে দেশগুলি বর্ণবিদ্বেষে উস্কানি দিচ্ছে তাদের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার অধিকার কেড়ে না নিচ্ছে, তত দিন এই প্রবণতা চলতেই থাকবে।
বর্ণবিদ্বেষকে হারিয়ে দিয়ে ফুটবল, ফুটবলপ্রেমী আর খেলোয়াড়ি মনোভাব জিততে পারবে কি না শেষ পর্যন্ত, রাশিয়ার সামনে সেটাই এ বারের সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ।