তা মিলনাড়ুতে জয়ললিতা জয়রাম জিতিলেন। ইহা কি অনুদানের জয়? এক টাকায় ইডলি, স্বল্পমূল্যে ঔষধ হইতে হাসপাতালে সুলভে চিকিৎসার জন্য কার্ড, সর্বত্রই জয়ললিতা নিজের ‘আম্মা’ নামটি জুড়িয়া তাহা প্রায় একটি ব্র্যান্ড করিয়া ফেলিয়াছেন। তাঁহার ‘উদারতা’ ভুলিবার ফুরসত দেন নাই তামিলনাড়ুর নাগরিকদের। বিরোধীদের দুর্বলতার জন্যও যে এআইএডিএমকে-র জয় হইয়াছে, সন্দেহ নাই। তাঁহার প্রধান প্রতিপক্ষ ডিএমকে প্রধান এম করুণানিধি অতিবৃদ্ধ, তাঁহার দুই পুত্র পরস্পরের প্রতিযোগী। অপরাপর ছোট দলগুলি বিরোধী ভোট ভাগ করিয়াছে। ভোটের হিসাবে জয়ললিতার দল পাইয়াছে ৪১ শতাংশ, নিকটতম প্রতিযোগী ডিএমকে ৩১ শতাংশ। এই ব্যবধান বলিয়া দেয়, শাসক দলের প্রতি জনসমর্থন যথেষ্ট। অনুদানের কার্যকারিতার প্রশ্নটি তাই গুরুত্ব পাইয়াছে।
এ রাজ্যেও অনুদান লইয়া উদ্বেগ দেখা দিয়াছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভর্তুকির শস্য, ন্যায্যমূল্যের ঔষধকে নির্বাচনী যুদ্ধের অস্ত্র করিয়াছেন। জয়ললিতা বিনামূল্যে টিভি দিবার প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন, মমতা স্কুলের ব্যাগ, জুতো দিবেন। দুই নেত্রীর বিরুদ্ধেই বিরোধীদের প্রধান প্রচার ছিল দুর্নীতির। তাহা ধোপে টিকে নাই। নাগরিকের প্রতি দুই নেত্রী উপুড়হস্ত বলিয়াই তাঁহাদের ঝুলি ভরিতে জনগণ দ্বিধা করে নাই, এমনই ব্যাখ্যা মিলিতেছে। ফলে প্রশ্ন উঠিয়াছে, রাজস্ব হইতে অঢেল খরচ করিয়া ভোট কিনিবার চেষ্টাকে জনগণ যদি পুরস্কৃত করেন, তবে তাহা কি নেতাদের অভ্যাসে পরিণত হইবে না? পরস্পরের প্রতি প্রতিযোগিতা করিয়া দলগুলি অনুদান বাড়াইতে থাকিবে। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি, পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য যে অর্থ ব্যয় হইতে পারিত, তাহা দান-খয়রাতিতে খরচ হইবে। ইহা কি অপরিণামদর্শী রাজনীতি নহে?
এই প্রশ্ন নির্বাচনের রাজনীতির সহিত উন্নয়নের অর্থনীতিকে মুখোমুখি আনিয়াছে। উন্নয়নের অর্থনীতি কিন্তু গরিবের প্রতি সকল অনুদানকেই ‘অপচয়’ বলিয়া উড়াইয়া দেয় নাই। ছয়টি উন্নয়নশীল দেশে একটি সমীক্ষার ফল বরং বলিয়াছে, গরিবকে এককালীন অনুদান কার্যত দীর্ঘমেয়ািদ সুফল দিতেছে। যথাযথ প্রয়োগে সুলভে বা বিনামূল্যে শস্য, ঔষধ, অর্থ বিতরণ বাস্তবিক দারিদ্র নিরসনের কাজে লাগিতে পারে। রাজনীতির বিচারেও, অনুদানের রাজনীতির প্রতি দরিদ্রের আকর্ষণকে তাহার লোলুপতা বলিলে অন্যায় হইবে। যে দল গরিবের চাহিদার প্রতি মনোযোগী, সমস্যার প্রতি সংবেদশীল, স্বার্থে সক্রিয়, গরিব তাহাকেই পুরস্কৃত করিবে, তাহাতে আশ্চর্য কী? একজোড়া জুতার জন্য গরিব ভোট দেয়, এমন ভাবা অন্যায়। গরিব শিশুর নগ্নপদে বিদ্যালয়ের যাইবার ব্যথাটা যে নেতা বুঝিয়াছেন, তাহাকে গরিব ভোট দেয়। ইহা অ-বৈষম্যের রাজনীতির পুরস্কার। যথাযথ নীতি গ্রহণ করিলে দারিদ্র নিরসন উৎপাদন ও আয় বৃদ্ধির অন্তরায় হইয়া দাঁড়ায় না। বরং দরিদ্রের প্রতি দৃকপাতহীন আর্থিক বৃদ্ধি রাষ্ট্র ও সমাজে সংকটের জন্ম দেয়, সে বিষয়ে বারবার সতর্ক করিয়াছেন অমর্ত্য সেন প্রমুখ অর্থনীতিবিদ। ভারতে বিশ্বায়নের পর আর্থিক বৃদ্ধি হওয়া সত্ত্বেও দরিদ্র, নারী, নিম্নবর্ণ তাহার সুবিধা পায় নাই। তাহাদের কাছে আর্থিক বৃদ্ধির সুফল পৌঁছাইবার একমাত্র পথ অনুদান নহে। কিন্তু তাহাও একটি পথ। তবে, অনুদানের রাজনীতির সুফল যাহারা পাইয়াছেন, অনুদানকে উন্নয়নের নীতি করিবার দায় সেই নেতাদের।