ভ্যালেন্টাইন’স ডে-তে কেরলের এক সমুদ্রসৈকতে এক যুগল বসিয়াছিলেন, তাঁহাদের নিগ্রহ করা শুরু করে একদল যুবক। শুধু নিগ্রহ করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, সমগ্র ঘটনাটির ভিডিয়ো তাহারাই তুলিয়া রাখে এবং তাহার পর তাহা সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলিয়া দেয়। যুবকটি পুলিশেও নালিশ করেন, কিন্তু কোনও ফল হয় না। নিগ্রহকারীরা ফেসবুকে যুগলের ছবি তুলিয়া দিয়া, অবমাননাকর মন্তব্য ছড়াইতে থাকে। বাইশবর্ষীয় যুবাটি সহ্য করিতে না পারিয়া, ২৩ ফেব্রুয়ারি গলায় দড়ি দিয়া আত্মহত্যা করেন। তাঁহার সুইসাইড নোটের ভিত্তিতে পুলিশ পাঁচ জনকে গ্রেফতার করিয়াছে। কে প্রেম করিবে ও কী ভাবে— তাহা নির্ধারণ করিয়া দিবার নীতি-মস্তানির বিরুদ্ধে কেরলের মুখ্যমন্ত্রীও সরব হইয়াছেন। কিন্তু লক্ষণীয়: সোশ্যাল মিডিয়ায় অপমান করিবার এই নূতন দস্তুর। কখনও বিখ্যাত, কখনও সাধারণ মানুষকে ‘ট্রোল’ করা হইতেছে ইদানীং অতিপ্রচলিত এক অভ্যাস। কাহাকেও অপমান বা অপদস্থ করিবার মধ্যে প্রবল কৃতিত্ব রহিয়াছে— এই বিকৃত মানসিকতা বহু দিন ধরিয়াই কিছু মানুষের নিকট প্রশ্রয় পাইত, কিন্তু তাহা প্রাক-ফেসবুক যুগে এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করে নাই। এখন যে কোনও মানুষ যে কোনও মানুযের বিরুদ্ধে কুৎসিত বিষোদ্গার করিয়া যাহা খুশি লিখিয়া, বা তাহার ছবির সঙ্গে বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য জুড়িয়া, সর্বজনের সম্মুখে দর্শাইতে পারে, ও তাহা বিনা বাধায় বিশ্বে ছড়াইয়া পড়িতে পারে।
কিছু দিন পূর্বে সিপিএম-এর এক যুবনেতাকে লইয়া অনুরূপ অশান্তি দানা বাধিয়াছিল। তিনি তাঁহার এক ট্রোল-কারীর চাকুরিকর্তার নিকট নালিশ ঠুকিয়া দিয়াছিলেন, হয়তো চাকুরি খাইয়া শোধ তুলিতেন। তাহা যেমন ক্ষমতার অপব্যবহার বলিয়া সঙ্গত ভাবেই চিহ্নিত হইয়াছে, তেমন ইহাও ঠিক যে, বিখ্যাত মানুষদের যাহা খুশি বলিবার চমৎকার সুযোগ পাইয়া অনেকেই নিজের অন্যায় প্রবৃত্তিগুলিকে ফোয়ারার ন্যায় উচ্ছ্বাসে প্রকাশ করিতে শুরু করিয়াছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প বা জাস্টিন বিবার হইলে প্রশস্তির পাাশাপাশি ব্যঙ্গ সহিতে হইবে, ইহা যেমন স্বাভাবিক, তেমনই উহার লাগাম প্রায়ই ছাড়িয়া যাইবে, বা বে-লাগাম হইবার আনন্দ উপভোগ করিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে অহেতুক আঘাত করিবার অভ্যাস জন্মাইয়া যাইবে, এই আশঙ্কাও কষ্টকল্পনা নহে। সোশ্যাল মিডিয়া এমনই প্রকৃত গণতান্ত্রিক এক পরিসর, সকলেই সমান প্রাবল্যের সহিত নিজ অধিকার কায়েম করিতে পারে। বদ লোকেরা যদি ইহাকে মানুষ-নিগ্রহ করিবার মোক্ষম উপায় ঠাওরাইয়া লয়, কলেজের ন্যায় নিষ্ঠুর র্যাগিং করিয়া ধর্ষকাম চরিতার্থ করিবার স্থানও হইয়া উঠে টুইটার বা ইউটিউব, তাহা হইলে প্রশাসনকে তৎপর হইয়া উঠিতে হইবে।
সকলে হয়তো আত্মহত্যা করিতেছেন না, কিন্তু অবসাদের শিকার কত জন হইতেছেন, কে জানে। যে যুবক আত্মহত্যা করিলেন, তাঁহার সহিত যে বান্ধবী ছিলেন, তিনি কেমন করিয়া এই স্মৃতি ও বিয়োগ সমগ্র জীবন বহিয়া বেড়াইবেন, তাহাও কম উদ্বেগের নহে। যেমন ফেসবুকে যাহা খুশি পোস্ট করিবার অধিকার কাড়িয়া লওয়া যায় না, তাহা বাক্স্বাধীনতার অপলাপ হইবে, তেমনই উহার মাধ্যমে অন্য নাগরিকের অধিকার হরণ শুরু হইলে প্রশাসনের তরফে হাত গুটাইয়া বসিয়া থাকাও যায় না। সাইবার-জগৎ এখন আমাদের পরিচিত জগৎটির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, ফলে সুস্পষ্ট জাগতিক আইনের আওতায় ইহাকে আনিতেই হইবে। কেমন করিয়া এই জটিল কার্য সম্পন্ন হইবে, তাহা করিতে গিয়া রাষ্ট্র পরোক্ষে নিজ পেশিপ্রদর্শনই করিবে কি না, তাহা বহু তর্কের ব্যাপার। কিন্তু ইহাকে অনন্ত স্বাধীনতার ময়দান হিসাবে ছাড়িয়া দিলে সমস্যা ঘটিবেই, কারণ বহু মানুষ স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারের মধ্যবর্তী সীমারেখাটি সম্পর্কে সচেতন নহে।
যৎকিঞ্চিৎ
কেউ বলছে মহাতারকা হয়ে গাধাদের বিজ্ঞাপন করা ঠিক নয়। অর্থাৎ গাধা বোকা, তার সমর্থকও বোকা। কেউ বলছে, গাধা দুরন্ত জানোয়ার: অতি পরিশ্রমী, সৎ, প্রভুর অনুগত। একটা নির্বাচনে গাধা ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ হয়ে যাবে, আমেরিকাতেও ভাবা শক্ত, যেখানে একটা প্রধান দলের চিহ্নই হল গাধা। আবার, যে-ভারতে গরুকে প্রকাণ্ড সম্মান দেওয়া হয়, সেখানে গাধাই বা কেন বিশ্লেষণের বিষয় হবে না? নেতাদের জীবে প্রেম বাড়তে বাড়তে মানুষ অবধি পৌঁছবে: আশা।