সম্পাদকীয় ২

অবারিত কদর্যতা

যে কোনও বাস্তুব্যবস্থায় কিছু পরজীবী থাকে। কিন্তু কিছু পরজীবী আশ্রয়দাতা প্রাণীটিকে গ্রাস করিয়া ফেলে। তেমন ভাবেই কি দালালরা গ্রাস করিয়াছে সরকারি চিকিৎসাকে? এসএসকেএম হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটার হইতে সংজ্ঞাহীন রোগীকে বহিষ্কার করিয়াছেন চিকিৎসকেরা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৬ ০০:৪৮
Share:

যে কোনও বাস্তুব্যবস্থায় কিছু পরজীবী থাকে। কিন্তু কিছু পরজীবী আশ্রয়দাতা প্রাণীটিকে গ্রাস করিয়া ফেলে। তেমন ভাবেই কি দালালরা গ্রাস করিয়াছে সরকারি চিকিৎসাকে? এসএসকেএম হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটার হইতে সংজ্ঞাহীন রোগীকে বহিষ্কার করিয়াছেন চিকিৎসকেরা। অপরাধ, তিনি দালাল-বিক্রিত সরঞ্জাম কেনেন নাই। সরকারি হাসপাতালে দুর্নীতি নূতন নহে। তবু এই ঘটনার কদর্যতা মাত্রা ছাড়াইয়াছে। দালালকে তুষ্ট রাখিতে রোগীকে প্রত্যাখ্যান করিবেন চিকিৎসকেরা, ইহা অকল্পনীয়। কেন শীর্ষ হাসপাতালের অস্ত্রোপচার কক্ষের সম্মুখে চিকিৎসা সরঞ্জাম লইয়া দাঁড়াইয়া থাকে দালাল? ‘কাট মানি’-র প্রলোভন সরকারি চিকিৎসকদের একটি অংশকে কি নিবীর্য ক্রীতদাসে পরিণত করিয়াছে? চিকিৎসক সমাজ, বিশেষত চিকিৎসকদের সংগঠনগুলি এমন নীতিহীনতার দৃষ্টান্তের বিরুদ্ধে কিছু পরিচিত যুক্তি দিয়া থাকেন। যথা, সকল পেশাতেই কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত লোক রহিয়াছে। তাহাদের দিয়া সকলের বিচার অনুচিত। একটু তলাইয়া দেখিলে স্পষ্ট হয়, সমস্যাটি সহজ নহে। সরকারি চিকিৎসাব্যবস্থায় অনৈতিক কাজের কিছু মৌলিক নকশা তৈরি হইয়াছে, যাহা জনস্বার্থকে বিঘ্নিত করিতেছে। কেবল এ রাজ্যে নহে, গোটা দেশেই এই চিত্র। অনৈতিকতা ও অপচয় রোধ করিবার যতগুলি উদ্যোগ গৃহীত হইয়াছে, তাহাও চিকিৎসকেরা পরিকল্পিত ভাবে প্রতিহত করিতেছেন। ইতিপূর্বে দুটি রাজ্যে চিকিৎসকদের যথাসময়ে উপস্থিতি নিশ্চিত করিবার প্রকল্প পরীক্ষামূলক ভাবে প্রয়োগ করা হইয়াছিল। দুটি ক্ষেত্রেই তাহা ব্যর্থ হইয়াছে।

Advertisement

এ রাজ্য হইতে একটিই উদাহরণ যথেষ্ট: অপ্রয়োজনীয় ঔষধ। প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র হইতে মেডিক্যাল কলেজ, সর্বস্তরের সরকারি হাসপাতালে অকারণে অতিরিক্ত ঔষধ লেখা হইতেছে, ইহা কার্যত প্রমাণিত। ইহা আটকাইতে তৃণমূল পরিচালিত রাজ্য সরকার ‘জেনেরিক’ ঔষধ লিখিবার নির্দেশ দিয়াছিল। ইহা বিজ্ঞানসম্মত, জনস্বার্থসম্মত এবং অপচয় প্রতিরোধকারী। তদুপরি সরকারি হাসপাতালগুলিতে বিনামূল্যে প্রচুর ঔষধ ও সরঞ্জাম দিতেছে সরকার। হাসপাতালের তহবিলে টাকা দিবার ফলে প্রয়োজন অনুসারে খরচের বিষয়ে যথেষ্ট নমনীয়তাও আনা হইয়াছে। কিন্তু চিকিৎসকেরা প্রায় সংঘবদ্ধ হইয়া এই সরকারি প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করিবার অভিযানে নামিয়াছেন। সাদা চিরকুটে ব্র্যান্ডেড ঔষধ লিখিয়া চলিয়াছেন, দালালদের নিকট সরঞ্জাম কিনিতে বাধ্য করিতেছেন।

তৃণমূল কংগ্রেস সরকার রোগীর জন্য উপুড়হস্ত, কিন্তু দোষী ডাক্তারের প্রতি খড়্গহস্ত হইতে নারাজ। মেডিক্যাল কলেজের নবজাতক ইউনিটে পুড়িয়া মরিয়াছিল দুই শিশু। দেড় বৎসর পরেও তাহার তদন্ত শেষ হয় নাই। লেডি ডাফরিনে ভুল ইঞ্জেকশনের ঘটনাটিও তদন্তাধীন। এসএসকেএম-এর তদন্তও সেই পথে চলিবে। যদি বা ডাক্তারদের বদলি হয় কিংবা পদোন্নতি ব্যাহত হয়, তাহা কি ‘প্রতিকার’? অস্ত্রোপচার কক্ষ হইতে রোগীকে বাহির করিবার মতো অপরাধ যেখানে ঘটিতে পারে, সেই ব্যবস্থার পরিবর্তন হইবে কী রূপে? চিকিৎসকেরা নিজেদের নিরাপত্তা লইয়া অতি-সংবেদনশীল। ডাক্তাররা কত বিপন্ন, ধর্মঘট করিয়া তাঁহারা বারবার বুঝাইয়া দেন। অথচ অ-চিকিৎসা, অপচিকিৎসার ফাঁস যে রোগীর গলায় নিত্য পড়িতেছে, তাহা লইয়া টুঁ শব্দটি কেহ করেন না। দ্বিচারিতাও দুর্নীতির নামান্তর।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন