সম্পাদকীয় ১

আইনের গরু

গৃহস্থের হাঁড়ির খবর রাখা রাষ্ট্রের কাজ নহে। মহারাষ্ট্র সরকারকে তাহা মনে করাইতে ২৪৫ পৃষ্ঠার রায় লিখিতে হইল মুম্বই হাইকোর্টকে। আদালত বলিয়াছে, ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ না করিবার অধিকার ভারতের নাগরিকের মৌলিক অধিকার।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৬ ০০:২২
Share:

গৃহস্থের হাঁড়ির খবর রাখা রাষ্ট্রের কাজ নহে। মহারাষ্ট্র সরকারকে তাহা মনে করাইতে ২৪৫ পৃষ্ঠার রায় লিখিতে হইল মুম্বই হাইকোর্টকে। আদালত বলিয়াছে, ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ না করিবার অধিকার ভারতের নাগরিকের মৌলিক অধিকার। কাহার গৃহে সে কী খাইতেছে, তাহা লইয়া রাষ্ট্রের নজরদারি, নিষেধাজ্ঞা বা শাস্তিপ্রদান সংবিধান-বিরোধী। তাই মহারাষ্ট্র সরকারের একটি আইনের কিছু অংশকে ‘অসাংবিধানিক’ আখ্যা দিয়াছে হাইকোর্ট। ২০১৫ সালে সংশোধিত ১৯৭৬ সালের ওই আইনটির বক্তব্য ছিল, মহারাষ্ট্রে কাহারও নিকট গোমাংস মিলিলে তাহাকেই প্রমাণ করিতে হইবে যে, সেই রাজ্যে গরুটির হত্যা হয় নাই, বা গোমাংস ভক্ষণের নিমিত্ত রাখা হয় নাই। আইনের ওই অংশ বাতিল করিয়া আদালত বলিয়াছে, সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নহে, মাংস গরু, মহিষ, বলদ নাকি অপর কোনও জীবের। মাংস রাজ্যেই উৎপাদিত হইয়াছে না অন্য রাজ্যে, তাহাও জানা সম্ভব নহে। অতএব এই দায়গুলি নাগরিকের উপর চাপানো অসংগত। গোমাংস খাইবার জন্য জেল-জরিমানার শাস্তিও খারিজ হইয়াছে। আদালতের রায়ে বলা হইয়াছে, যাহা স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর নহে, এমন যে কোনও খাদ্য খাইবার অধিকার নাগরিকের আছে। ব্যক্তিস্বাধীনতা না থাকিলে অর্থপূর্ণ জীবন বাঁচা সম্ভব নহে। সংবিধানের ‘বাঁচিয়া থাকার’ মৌলিক অধিকার বস্তুত অর্থপূর্ণ জীবন বাঁচিবার অধিকার। রাষ্ট্র তাহাতে হস্তক্ষেপ করিতে পারে না।

Advertisement

মুম্বই হাইকোর্ট আরও এক বার মনে করাইল, রাষ্ট্র গুরুমহাশয় নহে। গণতন্ত্রে ব্যক্তির মর্যাদা সর্বাধিক। তাহার সম্মান ও সুরক্ষাই রাষ্ট্রের কাজ। ব্যক্তির সিদ্ধান্ত বৃহত্তর সমাজকে কোনও ভাবে বিপন্ন করিলে তবেই রাষ্ট্র সে বিষয়ে কোনও হস্তক্ষেপের কথা চিন্তা করিতে পারে। তাহার অর্থ ইহা নহে যে, আইনের যষ্টি হাতে লইয়া সরকার নাগরিককে তাড়া করিয়া বেড়াইবে। প্রচার, জনমত গঠন, সামাজিক উদ্যোগ, প্রশাসনিক বিধিনিষেধের সফলতর প্রয়োগ, এমন নানা উপায়ে কাজ না হইলে, তবেই আইন তৈরির পথে হাঁটিতে হইবে। দুঃখের বিষয়, এই কথাটি নেতারা বার বার ভুলিয়া যান। যে কোনও ছুতায় আইন প্রণয়ন করিয়া নাগরিককে ব্যস্ত-সন্ত্রস্ত করাতেই যেন তাঁহাদের আমোদ। ফলে আদালতকে সময় নষ্ট করিয়া অকারণ আইনগুলি বাতিল করিতে হয়।

তবে আদালতের রায়টি আরও একটু চিন্তা দাবি করে। বিচারপতিরা গোমাংস ভক্ষণকে অবৈধ বলিয়া না মানিলেও, গোহত্যা নিবারণী আইনকে অবৈধ বলেন নাই। সে বিষয়ে মহারাষ্ট্র সরকারের যুক্তি তাঁহারা গ্রহণ করিয়াছেন। তাহা এই যে, গরু-বলদের কর্মজীবন ফুরাইলেও তাহাদের মল হইতে জৈব সার, জ্বালানি, বায়োগ্যাস উৎপন্ন হয়। তাই জনস্বার্থে কৃষিপ্রধান রাজ্যে তাহাদের হত্যা করা উচিত নহে। গোময়ের ব্যবহারও পরিবেশের অনুকূল নহে। এ দেশে পরিবেশ রক্ষায় আদালতের ভূমিকা সুবিদিত। অথচ বিচারপতিরাই গোময়ের ব্যবহারের পক্ষে দাঁড়াইতেছেন, ইহা কি বিস্ময়কর নহে? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন ঘরে ঘরে এলপিজি পৌঁছাইবার ব্রত লইয়াছেন, তখন ঘুঁটে-বায়োগ্যাসের নিমিত্ত গো-সংরক্ষণের প্রয়োজন কী? কিন্তু কৃষির প্রশ্নটি আরও গুরুত্বপূর্ণ। কোনও উন্নত দেশে কৃষি গো-নির্ভর নহে, গোবর-নির্ভর তো নহেই। গো-নির্ভরতা কৃষিকে অনুন্নয়নের ফাঁদে আটকাইয়া রাখে। ভারতেও কিছু রাজ্যে গোহত্যা নিষিদ্ধ নহে। সেখানে কি কৃষি অচল হইয়াছে? জৈব সার তৈয়ারিরও বহু পদ্ধতি আছে। গোবর একমাত্র উপাদান নহে। যে সব দেশে বাণিজ্যিক ভাবে ব্যাপক জৈব চাষ হয়, তাহার কতগুলাতে গোহত্যায় নিষেধাজ্ঞা রহিয়াছে? কৃষির গো-নির্ভরতা কাটানোই কর্তব্য। গোমাংস লইয়া মাথা ঘামাইবার প্রয়োজন নাই।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement