সম্পাদকীয় ২

আত্মপ্রকাশ

ব্যক্তির যৌন প্রবণতা ও যৌন পছন্দ নিতান্তই ব্যক্তিগত। কিন্তু যখন রক্ষণশীল সমাজ মানুষের ব্যক্তিগত যৌন প্রবণতার উপর ফতোয়া জারি করে, ব্যক্তির যৌন অধিকারকে খর্ব করিতে চাহে, তখন আপন ব্যক্তিগত পরিসরকে জনসমক্ষে উন্মুক্ত করিবার সৎ প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। সমাজের রক্তচক্ষুর জবাবে ‘অন্য রকম’ অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ হইতে ভিন্ন যৌনতায় বিশ্বাসী মানুষকে স্পষ্ট ভাষায় বলিতে হয়: ‘ইহা আমার নির্বাচন’। কাহারা বলিবেন?

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share:

ব্যক্তির যৌন প্রবণতা ও যৌন পছন্দ নিতান্তই ব্যক্তিগত। কিন্তু যখন রক্ষণশীল সমাজ মানুষের ব্যক্তিগত যৌন প্রবণতার উপর ফতোয়া জারি করে, ব্যক্তির যৌন অধিকারকে খর্ব করিতে চাহে, তখন আপন ব্যক্তিগত পরিসরকে জনসমক্ষে উন্মুক্ত করিবার সৎ প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। সমাজের রক্তচক্ষুর জবাবে ‘অন্য রকম’ অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ হইতে ভিন্ন যৌনতায় বিশ্বাসী মানুষকে স্পষ্ট ভাষায় বলিতে হয়: ‘ইহা আমার নির্বাচন’। কাহারা বলিবেন? অন্য যৌনতার সব মানুষের সামাজিক প্রতিষ্ঠা আর প্রতিপত্তি সমান নহে। যাঁহারা সামাজিক মাপকাঠিতে সাধারণ বলিয়া গণ্য, তাঁহারা বলিলে সমাজপতিরা ‘রে রে’ করিয়া আসিবেন, হাতে মাথা কাটিবেন। তাহা সত্ত্বেও সাহসী মানুষ আপন ভিন্ন-যৌনতার কথা বলিতে পারেন, কখনও কখনও বলিয়া থাকেন। কিন্তু তাহা ব্যতিক্রম। সচরাচর সাধারণ মানুষ বলিতে ভয় পান। স্বাভাবিক ভয়।

Advertisement

এখানেই অ-সাধারণ মানুষের বিশেষ ভূমিকা। যাঁহারা সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত, সম্মানিত, ক্ষমতাশালী, তাঁহারা অন্য যৌনতায় বিশ্বাসী বা অভ্যস্ত হইলে যদি সেই বিষয়ে আপন মত প্রকাশ করেন, তবে তাহাতে সমাজের মঙ্গল। কারণ সমাজ প্রতিষ্ঠার বশ, প্রতিষ্ঠিত মানুষের কথা সহজে ফেলিতে পারে না, অন্তত উড়াইয়া দিতে পারে না। সম্প্রতি গায়ক এলটন জন ও অ্যাপল সংস্থার সিইও টিম কুক তাঁহাদের যৌন প্রবণতার কথা ঘোষণা করিয়াছেন। বিশ্বের অপরাপর সমকামীদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করিয়াছেন। সমাজ এই মাপের নাগরিকদের ‘বহিষ্কার’ করিতে পারিবে না, শাস্তি প্রদান করিতে পারিবে না, অকারণ হেনস্তাও করিতে পারিবে না। সমকাম গোল্লায় যাওয়ার পথ, সমকামিতা অসুস্থ, আত্মহত্যাকামী, বিষণ্ণতাপ্রদায়ী— এই জাতীয় ভ্রান্ত এবং ভয়ানক রক্ষণশীল বিশ্বাসকে এই প্রতিভাবান ও সফল ব্যক্তিদের দ্বিধাহীন ঘোষণা চ্যালেঞ্জ জানাইতেছে।

ভারতের পক্ষে দৃষ্টান্তগুলি দ্বিগুণ প্রাসঙ্গিক, কারণ এ দেশে রক্ষণশীলতার চাপ অতি প্রবল, অন্য যৌনতায় বিশ্বাসীদের অবস্থা পশ্চিম দুনিয়ার বা পূর্বেরও অন্য কোনও কোনও দেশের তুলনায় অনেক বেশি বিপন্ন। রক্ষণশীল হিন্দুত্ববাদীরা তো সমকামকে বিদেশের আমদানি বলিয়া মনে করেন। এ দেশের মন্দিরগাত্রের ‘এরোটিকা’ তাঁহারা দেখেন না অথবা দেখিয়াও দেখেন না। কিন্তু প্রাচীন ভারতে সমকামের অস্তিত্ব ছিল কি না, তাহা যুক্তির বিচারে গৌণ। বর্তমান ভারতে তথা পৃথিবীতে বহু মানুষ সমকামী, ইহাই সমকামিতার স্বীকৃতির পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি। অথচ এই সমকামীদের ভারতীয় সমাজ ‘বিচিত্র’ জীব বলিয়া ভাবে। অনেক সময় বাবা-মা সন্তান সমকামী জানিয়াও লুকাইয়া ও জোর করিয়া বিবাহ দেন। ভাবেন, বিবাহের ঔষধিতে রোগ সারিয়া যাইবে। সম্পূর্ণ ভুল ধারণা, কুযুক্তি। সমকাম রোগ নহে, স্বাভাবিক প্রবণতা। স্বভাবগত, তাই স্বাভাবিক। দাম্পত্যের কৃপায় এই প্রবণতার অভিমুখ ঘুরিবে না, বরং দুজন মানুষের জীবনে অহেতুক জটিলতা নামিয়া আসিবে, সংকট সৃষ্টি হইবে। এমন করুণ ঘটনা বিস্তর ঘটিয়া থাকে। এই সমাজকে সংশোধনের অন্যতম দীর্ঘমেয়াদি উপায়: সরব হওয়া। ভারতীয় সমকামীদের মধ্যে যাঁহারা মোটের উপর প্রতিষ্ঠিত, চাকরিবাকরি করেন, তাঁহারা যৌন প্রবণতার কথা প্রকাশ্যে বলিলে সমাজের কান-মন ক্রমশ অভ্যস্ত হইয়া উঠিবে। অভ্যাসে মিলায় বস্তু।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement