আসুন, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই

এখন তো পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যেও তালিবানিকরণের প্রচেষ্টা নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালঠিক যে দিন প্রধানমন্ত্রী রাজধানীর অশোক রোডে বিজেপি-র সদর কার্যালয়ে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করে এক স্বচ্ছ ভারত গড়ার যৌথ প্রয়াসের কথা বলছিলেন, ঠিক তখনই এই দিল্লি শহরের ত্রিলোকপুরীতেই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ চরমে উঠেছে। দিনটি ছিল ভাইফোঁটার। সে দিন ত্রিলোকপুরীর একটি বাড়িতে বোন আসবে বলে কোনও এক ভাই সাতসকালে উঠে স্নান সেরে অপেক্ষা করছিল, তার পর বাবা-মাকে বলে রাস্তায় বেরিয়েছিল বোনের জন্য গরম জিলিপি কিনবে বলে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০৮
Share:

ঠিক যে দিন প্রধানমন্ত্রী রাজধানীর অশোক রোডে বিজেপি-র সদর কার্যালয়ে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করে এক স্বচ্ছ ভারত গড়ার যৌথ প্রয়াসের কথা বলছিলেন, ঠিক তখনই এই দিল্লি শহরের ত্রিলোকপুরীতেই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ চরমে উঠেছে। দিনটি ছিল ভাইফোঁটার। সে দিন ত্রিলোকপুরীর একটি বাড়িতে বোন আসবে বলে কোনও এক ভাই সাতসকালে উঠে স্নান সেরে অপেক্ষা করছিল, তার পর বাবা-মাকে বলে রাস্তায় বেরিয়েছিল বোনের জন্য গরম জিলিপি কিনবে বলে। ছেলেটি ফিরল বেশ কয়েক ঘণ্টা পর। তখন সে বুলেটবিদ্ধ। সারা শরীর রক্তস্নাত। বাইরে তখন দুই সম্প্রদায়ের কতিপয় মানুষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধেছে। পুলিশ গুলি চালিয়েছে। ইট যুদ্ধ হয়েছে দীর্ঘ সময়।

Advertisement

পর দিন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কাগজে প্রকাশিত ছবি: শূন্যপথ। ইটের ছড়াছড়ি রাস্তায়। ছবির ক্যাপশন ছিল: ব্রিক লেন। কোন ব্রিক লেনে আমরা বসবাস করছি যেখানে খোদ রাজধানীর প্রদীপের নীচেই এত অন্ধকার! কিন্তু ত্রিলোকপুরীতে এমন একটা ঘটনা কেন ঘটল? অনুসন্ধানকারী সাংবাদিকেরা বলছেন, বকরি ঈদ ও দীপাবলি কার্যত একই সময়ে পালন নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায়। মাতা কি চৌকি আছে যেখানে তার পাশেই মুসলিম সম্প্রদায়ের বসবাস। প্রশ্ন হচ্ছে, উপাসনাকে কেন্দ্র করে কেন এত হিংসা?

অমর্ত্য সেন তাঁর ‘পরিচিতি ও হিংসা’ নামক গ্রন্থে বলেছেন, এ হল সত্তার সঙ্কট এবং সত্তার পারস্পরিক সংঘাত। অন্যর সত্তাকে তার পরিসরটুকু দিতে না চাওয়া, সেটাই হল মূল সমস্যা। লিভ অ্যান্ড লেট লিভ!— এই দার্শনিক বহুত্ববাদী প্রত্যয়ের শিকড় নিয়েই আসলে টানাটানি। আর সেই কোন ছোটবেলা থেকে সাংবাদিকতার শিশুপাঠে বলা হয়েছিল, হিন্দু-মুসলমান সঙ্ঘাত বড় সংবেদনশীল বিষয়। এ সব লেখা যায় না। মুসলিম শব্দটি লেখাও কি সাম্প্রদায়িক? লিখতে হবে সংখ্যালঘু। কিন্তু ভারতে তো সংখ্যালঘু শিখ, পার্সি, জৈন, আরও কত সম্প্রদায়! নাস্তিকদেরও আসলে সংখ্যালঘু বলা যেতে পারে। লেখা যাবে না কিন্তু ভারতে হাঙ্গামার ইতিহাস সুপ্রাচীন। স্বাধীনতার কত কত বছর আগে তার শুরু। মোগল আমল থেকে ব্রিটিশ যুগ, ’৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত এই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয়েই চলেছে। ১৯৯০ সালে দেশে ৩৬ হাজার জনের মৃত্যু হয় সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামায়। তার সঙ্গে আছে পঞ্জাব, কাশ্মীর ও অসমের হিংসা। এর মানে প্রত্যহ গড়ে ১০০ জনের মৃত্য। (সূত্র: সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি, ৫/৩/১৯৯১)। সে সব মোকাবিলায় সরকারি প্রশাসনের ব্যর্থতাটা লেখা যাবে? (দ্রষ্টব্য গ্রন্থ: দাঙ্গার ইতিহাস, শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)।

Advertisement

পরিচ্ছন্ন জল ছাড়াই বসবাস করেন শতকরা ৬১ জন ভারতীয়। শতকরা ৪৪ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ ছাড়া বসবাস করেন। শতকরা ৯১ ভাগ মানুষের বাড়িতে টেলিফোন নেই। শতকরা ৩৮ জন মানুষ একটি ঘরে বসবাস করে (২০০৩ সালের পরিসংখ্যান সূত্র গ্রন্থ: Political and Incorrect The Real India warts and all. By Tavleen Singh)। এখানে পরিসংখ্যানের তত্ত্বতালাশ করাটা লক্ষ্য নয়, বলার বিষয় আমাদের অগ্রাধিকার কতটা বিকৃত (distorted priority)!

এ বার লোকসভা নির্বাচনের সময়েও হিন্দু জাঠ বনাম সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজের সংঘাত দেখা গিয়েছে মুজফ্ফরনগরে, অর্থাৎ পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের গ্রামাঞ্চলে। ভোট মেরুকরণের জন্য এ কাজ করা হয়েছিল, এমন অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ করেছে সমাজবাদী পার্টি এবং বিজেপি। এখন তো পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যেও তালিবানিকরণের প্রচেষ্টা নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজের জনসংখ্যা প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ। ’৯৩ সালে মুম্বই বিস্ফোরণের পরে যখন দাউদ ইব্রাহিমকে নিয়ে দেশ জুড়ে শোরগোল পড়ে যায় তখন ভারতীয় গোয়েন্দাবাহিনীর নজরদারি পশ্চিম উপকূলবর্তী এলাকায় অনেক বেড়ে যায়। আর তখনই আল কায়দা-তালিবান-পাক জঙ্গিরা পশ্চিমের বদলে পূর্ব উপকূলবর্তী এলাকাকে নিশানা করে ফেলে। বাংলাদেশকে মূল ঘাঁটি করে তারা ভারতে ঢোকার চেষ্টা শুরু করে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত দিয়ে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পশ্চিমবঙ্গেই সবচেয়ে বেশি। আর এই সীমান্তের অনেকটা অংশে আজও কাঁটাতারের বেড়া নেই। এই সুযোগ নিয়েই বহু দিন ধরে পশ্চিমবঙ্গকে বারুদের স্তূপ বানানোর চেষ্টা হচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে, ভারতীয় রাজনীতিকেরা সন্ত্রাস ও মুসলিম ভোটব্যাঙ্ককে এ দেশে একাকার করে ফেলেছেন।

ইসলামের ইতিহাস ঘাঁটলে কিন্তু দেখা যায়, স্বাাধীন যুক্তিবাদী চিন্তার একটা ধারা বরাবর মুসলিমদের মধ্যে ছিল। ওয়াকিবহাল ব্যক্তি মাত্রই জানেন, ইসলামি সভ্যতার প্রারম্ভিক পর্বে এক যুক্তিবাদী গোষ্ঠীর নাম ছিল মুতাজেলা। আধুনিক কালেও স্যর সৈয়দ আহমেদ, কাজী আব্দুল ওদুদের মতো অনেকে নিজেদের নয়া মুতাজেলাপন্থী হিসাবেই পরিচয় দিতে ভালবাসতেন। এই যুক্তিবাদী মুতাজেলাপন্থীরা শরিয়তকেও অন্ধ ভাবে অনুসরণ করার পক্ষপাতী ছিলেন না।

এই মুক্তমনে এক ভয়াবহ সঙ্কট এসেছে আজ। মুসলমান সমাজেও উদারপন্থী ইসলাম আর কট্টরবাদী ইসলাম— দু’ভাগে বিভক্ত জনসমাজ। সাধারণ মুসলিম মানুষ উদার, কতিপয় নেতা ধর্মব্যবসায়ী কট্টরবাদকে ব্যবহার করে ক্ষমতার রাজনীতি করেন। তবে সময়ের একটা দাবি আছে। যেমন, ইরানে শাসকদলও গোঁড়ামি থেকে বহু ক্ষেত্রে উদারপন্থী পথে যেতে বাধ্য হয়েছে। জাতীয়তাবাদী জিন্নার চিন্তার ক্রমবিবর্তন আজও এক অসাধারণ গবেষণার বিষয়। হাসান সুকর সম্প্রতি তাঁর ‘Indias Muslim Spring’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন মুসলমান সমাজও আজ কী ভাবে উন্নয়নের পথে এগোতে অনেক অনেক বেশি আগ্রহী।

তবু সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা হচ্ছে। একদা ব্রিটিশ পর্বে আমরা একতরফা ওদেরই দায়ী করেছি যেন ব্রিটিশ ভেদ নীতি ভারতে সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘাতের একমাত্র কারণ। কিন্তু ’৪৭ সালের পর বোঝা গিয়েছে, ভারতীয় সমাজের ভিতর সাম্প্রদায়িক সত্তার বিরোধ কোনও অংশেই কম নয়। আর তাই আজও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। সুমিত সরকার একদা লিখেছিলেন, ভারতের স্বদেশি আন্দোলন পর্বে হিন্দু জাতীয়তবাদী সভেনিজম মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম দিয়েছিল। কিন্তু আজ, ২০১৪ সালে দাঁড়িয়ে এ কথাও স্বীকার করতে হবে যে মুসলিম তোষণ নীতির ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতির প্রতিক্রিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিচ্ছে। এ হল মুদ্রার দু’টি দিক।

আসুন আমরা দু’টি প্রবণতারই বিরোধিতায় সোচ্চার হই!

অনিবার্য কারণে এই সপ্তাহে
‘শাহি সমাচার’ প্রকাশিত হল না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন