স্কুলে ইংরাজির পাঠ প্রয়োজন, বলিয়াছে সরকারি কর্তাদের একটি কমিটি। দেশের সকল স্কুলে অন্তত উচ্চ প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি পড়াইতে হইবে, এবং প্রতিটি ব্লকে অন্তত একটি ইংরাজি-মাধ্যম স্কুল চালু করিতে হইবে, এমনই প্রস্তাব দিয়াছে শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়ন বিষয়ক ওই কমিটি। উত্তম প্রস্তাব। ইংরাজি শিক্ষার বিষয়টি এ দেশে বরাবরই নানা আদর্শের সংঘাতে ঘুলাইয়া রহিয়াছে। ইংরাজ বিরোধিতার সহিত ইংরাজি বিরোধিতা, ইংরাজি বর্জনকে স্বদেশ-প্রেম বলিয়া দেখিবার প্রবণতা, এগুলি শিক্ষানীতিতে ইংরাজি শিক্ষার গুরুত্বকে খর্ব করিয়াছে। ইহাতে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে শিশুরা। ইংরাজি এখন আর কোনও একটি দেশের ভাষা নহে। সর্বাধিক ব্যবহৃত আন্তর্জাতিক ভাষাগুলির একটি। বিশ্বের নানা দেশে বিভিন্ন ভাষায় যাহা চর্চা হইতেছে, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্পের সেই সকল চর্চার প্রতিফলন ইংরাজিতে আসে প্রায় তৎক্ষণাৎ। ভারতীয় ভাষায় তাহার অনুবাদ হয় অনেক পরে, অতি অল্প। তাহার কারণ লইয়া বিতর্ক চলিতে পারে, প্রতিকারের চেষ্টাও চলিতে পারে, কিন্তু সত্যকে অস্বীকার করা চলে না। বস্তুত ইংরাজি যাঁহারা বলেন, ইংরাজ আজ তাঁহাদের অতি ক্ষুদ্র অংশ। বিভিন্ন মহাদেশে বিস্তৃত প্রাক্তন ব্রিটিশ উপনিবেশগুলি ভাষা ও সংস্কৃতিতে বিচিত্র হইয়াও ইংরাজির দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত। প্রায় প্রতিটি দেশ তাহার নিজের ভাষা ও উচ্চারণ অনুসারে নূতন শব্দ, পুরাতন শব্দের নূতন ব্যঞ্জনা, নূতন উচ্চারণ ইংরাজি ভাষায় যোগ করিয়াছে। ইংরাজি ভাষা সেই সকল শব্দ, শব্দার্থ সাগ্রহ গ্রহণও করিতেছে। অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি বছরে চার বার নূতন শব্দের তালিকা প্রকাশ করে। গত বৎসর অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর, এই তিন মাসে পাঁচশোটি নূতন শব্দ যোগ হইয়াছে। সেগুলির উৎপত্তি হইয়াছে নানা দেশে, নানা ভাষা হইতে, সবগুলির উৎস স্পষ্টও নহে। অতএব ইংরাজিকে ইংরাজের ভাষা বলিলে ভুল হইবে। তাহা সকল দেশের সকল শ্রেণির মানুষের ভাষা।
স্বদেশের প্রতি ভালবাসার সহিত বিদেশি ভাষার অনুশীলনের কোনও বিরোধ নাই, তাহা সম্প্রতি ব্যাখ্যা করিয়াছেন ইতিহাসবিদ সুগত বসু। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁহার বক্তৃতায় তিনি বলেন, স্বদেশি যুগের চিন্তানায়কদের মধ্যে অন্যান্য দেশের প্রতি আগ্রহ এবং চিন্তা বিনিময়ের আগ্রহ ছিল। সংকীর্ণতা পরিহার না করিলে স্বদেশপ্রেম সম্ভব নহে। একই সঙ্গে, ইংরাজিশিক্ষা সমাজে শ্রেণি বিভাজনকে গভীর করিবে, এমন আশঙ্কাও সঙ্গত নহে। বরং দরিদ্র শিশুকে ইংরাজি শিক্ষার সুযোগ দেওয়াই সামাজিক ন্যায়। তাহাতে উচ্চশিক্ষা ও রোজগারের সম্ভাবনা বাড়িবে। সরকারি স্কুলে ইংরাজি তাই প্রয়োজন।
ইংরাজি লইয়া জরুরি প্রশ্নটি নৈতিক নহে, প্রায়োগিক। এ রাজ্যে ইংরাজি শিক্ষা প্রথম শ্রেণি হইতে চালু হইয়াছে। কিন্তু ‘অসর সমীক্ষা ২০১৬’ দেখাইয়াছে, পঞ্চম শ্রেণির মাত্র বাইশ শতাংশ পড়ুয়া সরল ইংরাজি বাক্য পড়িতে পারে। অর্থাৎ ইংরাজি পড়াইতে হইবে কি না, সে তর্ক ছাড়িয়া ভাবিতে হইবে, কেমন করিয়া পড়াইলে শিশুরা ইংরাজি শিখিবে। যে প্রকরণে শিক্ষকদের তালিম দেওয়া হইতেছে, তাহা কার্যকর কি না, এবং শিক্ষক বাস্তবিক তাহা প্রয়োগ করিতেছেন কি না, তাহা দেখা প্রয়োজন। দেশের সকল পড়ুয়াকে ইংরাজি শিখাইবার ইচ্ছা দেরিতে আসিল, কিন্তু ইংরাজি শিখাইবার ক্ষমতা তৈরি করিতে আর বিলম্ব করা চলিবে না।