প্রবন্ধ ১

এই বিহার পিছন ফিরে হাঁটতে নারাজ

উন্নয়ন শিকেয় তুলে সংরক্ষণ, গোমাংস, জঙ্গলরাজ, পাকিস্তান ইত্যাদির ঘূর্ণিপাকে পড়ে মোদী ডুবে গেলেন। প্রগতির পথে না চললে বিহার কাউকে রেয়াত করবে না। দেওয়াল লিখনটা নীতীশদের কাছেও স্পষ্ট হয়ে যাওয়া উচিত।উন্নয়ন শিকেয় তুলে সংরক্ষণ, গোমাংস, জঙ্গলরাজ, পাকিস্তান ইত্যাদির ঘূর্ণিপাকে পড়ে মোদী ডুবে গেলেন। প্রগতির পথে না চললে বিহার কাউকে রেয়াত করবে না। দেওয়াল লিখনটা নীতীশদের কাছেও স্পষ্ট হয়ে যাওয়া উচিত।

Advertisement

ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৫ ০০:৪২
Share:

কদম কদম। ভোটের ফল ততক্ষণে স্পষ্ট। পটনা, ৮ নভেম্বর। রয়টার্স

নওয়াদা শহরের নির্বাচনী প্রচারের শেষ দিন। আমি তখন সেখানে। ট্রেনিং সেন্টারের বাইরে শহরের প্রধান সড়কে চা হাতে দাঁড়িয়ে, অবাক লাগছে যে ভোটের প্রায় কোনও চিহ্ন নেই, ব্যানার, দেওয়াল লিখন, ফেস্টুন, পতাকা কিছুই নেই। হঠাৎ চোখে পড়ল দুই দিক থেকে দুটো মিছিল আসছে। পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা হিসেবে প্রথমেই মনে হল, পালানো ভাল। তবু সহকর্মীর আশ্বাসে ওখানেই থেকে গেলাম। এক দিক থেকে একটা বড় সাইকেল মিছিল, নীতীশ-লালুর কাট-আউট সহযোগে। অন্য দিক থেকে গেরুয়া গাঁদাফুলে সাজানো গাড়ির সারি। দুটো মিছিল পরস্পরকে পেরিয়ে চলে গেল নিশ্চিন্তে, বেশ হাসিখুশি মেজাজে, অবাক কাণ্ড, কোনও রক্তপাত ছাড়াই।

Advertisement

এ বারের বিহারের নির্বাচন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল একটা সামাজিক এবং রাজনৈতিক উত্তরণের ছবি। পাঁচ দফায় নির্বাচন, যুযুধান দুই পক্ষ, শোনা যাচ্ছিল সমানে সমানে টক্কর। অথচ পুরোটা হয়ে গেল এক গণতন্ত্রের উৎসবের মেজাজে, প্রায় কোনও হিংসা বা রক্তপাতের ঘটনা ছাড়াই। ভোট পড়ল আগের চেয়ে অনেক বেশি, মহিলা ভোট পুরুষের চেয়ে বেশি। দেখিয়ে দিল, এই বিহারকে আর আগের মতো ভাবলে চলবে না। এই বিহার তরুণ, অনেক দিনের গ্লানি ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াতে চায়, স্বপ্ন দেখে, কোনও ভাবেই আর পিছনে হাঁটার পক্ষপাতী নয়।

এ বার ভোটের সময়টায় বিহারে ঘুরতে হয়েছে কাজের প্রয়োজনে, দু দফায় পাঁচ-ছয় দিনে রাস্তায় চলেছি দুই হাজার কিলোমিটারের বেশি, সতেরোটা জেলা ছুঁয়ে, কথা হয়েছে বহু মানুষের সঙ্গে। পরিবর্তনটা স্পষ্ট। অনায়াসে চলে যাওয়া যাচ্ছে রাজ্যের এ দিক থেকে ও দিক। পশ্চিম প্রান্তের গোপালগঞ্জ থেকে পূর্ব দিকে আরারিয়া, ৩৭০ কিলোমিটার পথ পেরোলাম সাড়ে পাঁচ ঘণ্টায়, বাধাহীন, ঝাঁকুনিহীন। বখতিয়ারপুর থেকে পটনা ঢোকার ৫০ কিলোমিটার পথ তো দুনিয়ার যে কোনও উচ্চমানের হাইওয়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। প্রান্তিক জেলা শহর, বা তার আশেপাশেও দিনে কুড়ি ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে, যা আজ বেঙ্গালুরুতেও পাওয়া দুষ্কর। বিদ্যুৎ ঢুকছে গ্রামেও, তার কাজ দেখা যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা আগের থেকে অনেক ভাল।

Advertisement

সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে, মহিলাদের ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসা। মাধেপুরা থেকে আরারিয়া যাচ্ছি— এই সীমাঞ্চল মুসলিম-অধ্যুষিত— দেখতে পাচ্ছি দলে দলে মুসলিম মেয়েরা সাইকেল চড়ে স্কুল বা কলেজ যাচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় মহাদলিত সম্প্রদায়ের জন্য স্কিল ট্রেনিং চলছে, মেয়েদের উপচে পড়া ভিড়, স্বাস্থ্যকর্মী বা বিউটিশিয়ান হওয়ার তালিম নেওয়ার জন্য প্রচুর মেয়ের ভিড়। সাত-দশ কিলোমিটার দূর থেকেও সাইকেল নিয়ে তারা চলে আসছে ট্রেনিং নিতে। কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাদের পরিবারের বড়দেরও যথেষ্ট উৎসাহ আছে তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার ব্যাপারে। নীতীশের সাইকেল প্রকল্প মেয়েদের নিজেদের জন্য এই স্বপ্নটা দেখাতে পেরেছে। তার অনেক নিদর্শন চার দিকে ছড়িয়ে। নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা— ট্রেনিংয়ের একটা বিজ্ঞাপনে পশ্চিমবঙ্গে যেখানে একশো ফোন আশা করাও দুরাশা, সেখানে বিহারে একটা বিজ্ঞাপনে ১৮০০০ ফোনকল, বিজ্ঞাপন বার হওয়ার এক মাস পর পর্যন্ত। অর্থাৎ, কিছু একটা করার ইচ্ছেটা বিহারের তরুণতরুণীদের মধ্যে আজকাল প্রবল।

না হওয়াও আছে অনেক। পুরসভাগুলির অবস্থা করুণ। রাস্তা খারাপ, নিকাশি ঠিকঠাক নেই, জঞ্জাল চতুর্দিকে, সে গয়া, ভাগলপুর হোক কিংবা পটনা। গঙ্গার উপর ব্রিজগুলোর এখনও ভগ্নদশা— হাজিপুরে সিমারিয়াতে অথবা ভাগলপুরে। কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত বড় শিল্প ছাড়া বিনিয়োগ বা জীবিকার চিত্র বেশ মলিন। বেসরকারি বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। দশ কোটি লোকের ৬০ শতাংশ ২৫ বছরের নীচে, দেশের সব রাজ্যের মধ্যে এই হার বিহারে সবচেয়ে বেশি। ফলে দলে দলে রাজ্য ছেড়ে কাজেও সন্ধানে ভিন রাজ্যে পাড়ি— মুম্বই, দিল্লি কিংবা পঞ্জাব।

তাই, নীতীশের প্রতি মোটের ওপর খুশি হলেও আরও উন্নয়নের জন্য বুভুক্ষু বিহার। তাই, ২০১৪-র লোকসভা ভোটে বিজেপি-র উন্নয়নের স্লোগানে সাড়া দিয়েছিল বিহার, ভোট প্রায় উজাড় করে দিয়েছিল, যদি তাতে রাজ্যের উন্নতি হয়। তাই, এ বার ভোট-পর্বের শুরুতে টক্কর ছিল কাঁটায় কাঁটায়। অগস্ট মাসের মাঝামঝি প্রথম ‘মহাসভা’য় যখন প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা হল ১,২৫০০০ কোটি টাকার বিহার প্যাকেজ, তখন তাতে উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো। নীতীশ কুমারকে সেই সময় একটু নড়বড়েই লাগছিল।

কিন্তু সেটাই বোধহয় উন্নয়ন বিষয়ে বিজেপি-র শেষ শব্দ উচ্চারণ। তার পর যত ভোট এগিয়েছে, একের পর এক সভা থেকে যে কথাগুলো এসেছে, তাতে সাধারণ বিহারবাসীর স্বপ্নভঙ্গই ঘটেছে। যত দিন এগিয়েছে, উচ্চবর্ণ ছাড়া আর সমস্ত জাতি বা জনজাতি থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে ফেলার এক অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছে বিজেপি। আপাতভাবে শ্রেণিবৈষম্য বা ভেদরেখার ইতিহাস সত্ত্বেও যাদব কুর্মি দলিত মহাদলিত মুসলমান সবাইকে এত অল্প সময়ে এক ছাদের তলায় ঠেলে দেওয়ার এমন আত্মঘাত প্রায় নজিরবিহীন।

নীতীশ ও লালুর এক হতে পারার ঘটনাও এক রাজনৈতিক উত্তরণের সাক্ষী। অঙ্কের হিসেব যা-ই হোক, সেই ভোটটাকে সংহত করা সহজ কথা নয়। যদি পিছিয়ে পড়া সব জনগোষ্ঠী তার পুরোনো ভেদাভেদকে সরিয়ে রেখে অন্য কোনও এক প্রাপ্তির আশায় সামনে তাকায়, তবেই তা বাস্তব হতে পারে। বিজেপি-র প্রতিটি নির্বাচনী (অপ)কৌশল নিশ্চয়ই তাতে অনুঘটকের কাজ করেছে, কিন্তু উত্তরণটা অন্য দিক থেকেও ঘটেছে। হায়দরাবাদ থেকে উড়িয়ে এনে উগ্র মৌলবাদীকে দিয়ে মুসলিমপ্রধান সীমাঞ্চল এলাকায় প্রচার করানোর প্রয়াসও মুখ থুবড়ে পড়েছে। দলে দলে মানুষ ভোট দিতে এসেছেন, বুথে উপচে পড়েছে মহিলাদের ভিড়। বাড়ির যাঁরা জীবিকার জন্য রাজ্যের বাইরে (সেটা মোট ভোটারের ২০ শতাংশের কম নয় কিন্তু), তাঁরাও বাড়ির লোককে ভোট দিতে উৎসাহিত করে গিয়েছেন। ভোটের ঠিক আগে প্রচুর লোকের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, তাঁরা ভোট দেবেন একটা আর্থসামাজিক পরিবর্তনের তাড়না থেকেই। বলতে শুনেছি, পিছিয়ে-পড়া মানুষের কাছে ভোট একটা সামাজিক লড়াই, রাজনীতির পরিবর্তন তাঁদের জীবনকে অনেক বেশি প্রভাবিত করতে পারে, যা উচ্চবর্ণ বা বিত্তশালীর ক্ষেত্রে করে না। অন্য দিকে, বিজেপি-র ভোটব্যাঙ্ক যে উচ্চবর্ণ, তাঁদের স্পষ্টতই সেই তাগিদটা কম, বাড়ির অনেক সম্ভাব্য ভোট তাই বুথ অবধি পৌঁছয়নি। ঘন্টার পর ঘন্টা নিচু জাতের মানুষের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিতে হবে, এই ‘সামাজিক অবক্ষয়’ থেকে নিজেদের দূরে রাখার জন্য এই শ্রেণির অনেকে, বিশেষত মহিলারা, ভোট দিতেই আসেননি।

এই আলোচনায় আর একটি নাম অবশ্যই উল্লেখ করার মতো: প্রশান্ত কিশোর। ভোট তো আজ ব্র্যান্ড তৈরির খেলাও বটে। গত গত লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদীর হয়ে সংলাপ আর সংযোগের মায়াজাল বিস্তারে তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এ বারের ভোটে তিনি নীতীশ শিবিরে। নীতীশের প্রতিটি সংলাপ তাই যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত হয়েছে। বিজেপি থেকে যখন উন্মত্ত প্রচার ও কুৎসার বন্যা বইছে, সেখানে নীতীশ কুমারের প্রতিটি প্রতিক্রিয়া থেকেছে সংযত, শান্ত। যেটুকু উগ্র প্রতিক্রিয়া মহাজোটের দিকে থেকেছে, তা এসেছে লালুর মুখ থেকে, নীতীশ নয়। তার ফলে, পুরো দুই মাস ধরে, প্রতিদিন সাধারণ বিহারবাসীর চোখে প্রধানমন্ত্রীর গরিমা ধুলোয় মিশেছে, উজ্জ্বল হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর ইমেজ।

সারা জীবন যাদের বিহারি বা খোট্টা বলে বাঙালির আত্মপ্রসাদ লাভের অভ্যেস, তাদের থেকে কি বাংলা ও বাঙালির কিছু শেখার আছে? আরারিয়া থেকে পূর্ণিয়া ছুঁয়ে মসৃণ হাইওয়ে দিয়ে যেই ডালখোলা হয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকেছি, গর্ত আর এবড়োখেবড়ো হতশ্রীপনা চার দিকে হঠাৎ জেগে উঠল। বড়ই প্রতীকী। সীমানার ও পারে অনেক সংকট, অনেক না-পাওয়ার মধ্যেও গণতন্ত্র তার উত্তরণের উৎসব চালু রাখতে পারে, আর এ পারে এসেই গণতন্ত্রের দুর্নিবার অবনমনের ছবি। ও দিকে এত উত্তেজনাতেও রক্তপাত নেই, এ দিকে ভোটের ছয় মাস বাকি থাকতেই রক্ত ঝরছে গ্রামে গ্রামে।

আজকের বিহার তাই একটা জরুরি বার্তা দেয়। এই যে পিছিয়ে-পড়া জনগোষ্ঠী সকলে মিলে নীতীশের ভরসা রাখা, এটা কম কথা নয়। লালু-পুত্র তেজস্বী উপমুখ্যমন্ত্রীর তেজে নীতীশ কুমার গ্রহণ লাগবে কি না, তা সময়ই বলবে। তবে দেওয়াল লিখনটা নীতীশদের কাছেও স্পষ্ট হয়ে যাওয়া উচিত। প্রগতির পথে না চললে বিহার কাউকেই রেয়াত করবে না। বিজেপি-র দিকে বিহারের মানুষ কিন্তু আশা নিয়েই তাকিয়েছিলেন। ভরসা রাখতে চেয়েছিলেন। বিজেপি সেই প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা না করে বড্ড বেশি পিছনের দিকে তাকিয়ে ফেলল। সংরক্ষণ, গোমাংস, জঙ্গলরাজ, পাকিস্তান ইত্যাদির ঘূর্ণিপাকে পা আটকে গিয়ে মোদী ডুবে গেলেন সরযূ-গঙ্গা জলে।

ইনথিঙ্ক গ্রুপের অধিকর্তা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন