সম্পাদকীয় ১

এক্তিয়ার

কিছু সুবিধা পাওয়াইয়া দেওয়ার বিনিময়ে ভোট প্রত্যাশা করা, ইহাই বর্তমানে ভারতীয় রাজনীতির সারাত্‌সার। নির্বাচন নিকটে আসিলে ভোট অর্জনের তাগিদও বাড়ে, ফলে পাওয়াইয়া দেওয়ার প্রবণতাও প্রবল হয়। কাজেই, নির্বাচন আসিলে শাসক দল কার্যত দানছত্র খুলিয়া বসিবে এবং ভোটের ময়দানে তাহার অন্যায্য ফয়দা তুলিবে, এই আশঙ্কা ঘোর বাস্তব। ভারতের নির্বাচন কমিশন এই প্রবণতাটি ঠেকাইতে অনস্বীকার্য ভূমিকা পালন করিয়াছে। ‘আদর্শ নির্বাচনবিধি’ আছে বলিয়াই শত ইচ্ছা থাকিলেও শাসক দলের হাত-পা বাঁধা ভোটের বাজারে প্রসাদ বিলাইবার উপায় নাই। নির্বাচনী মরসুমে অগণিত শিলান্যাসের একদা-পরিচিত কাহিনি আজ প্রস্তরযুগের ন্যায় প্রাচীন বোধ হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৪ ০০:০০
Share:

কিছু সুবিধা পাওয়াইয়া দেওয়ার বিনিময়ে ভোট প্রত্যাশা করা, ইহাই বর্তমানে ভারতীয় রাজনীতির সারাত্‌সার। নির্বাচন নিকটে আসিলে ভোট অর্জনের তাগিদও বাড়ে, ফলে পাওয়াইয়া দেওয়ার প্রবণতাও প্রবল হয়। কাজেই, নির্বাচন আসিলে শাসক দল কার্যত দানছত্র খুলিয়া বসিবে এবং ভোটের ময়দানে তাহার অন্যায্য ফয়দা তুলিবে, এই আশঙ্কা ঘোর বাস্তব। ভারতের নির্বাচন কমিশন এই প্রবণতাটি ঠেকাইতে অনস্বীকার্য ভূমিকা পালন করিয়াছে। ‘আদর্শ নির্বাচনবিধি’ আছে বলিয়াই শত ইচ্ছা থাকিলেও শাসক দলের হাত-পা বাঁধা ভোটের বাজারে প্রসাদ বিলাইবার উপায় নাই। নির্বাচনী মরসুমে অগণিত শিলান্যাসের একদা-পরিচিত কাহিনি আজ প্রস্তরযুগের ন্যায় প্রাচীন বোধ হয়। কিন্তু, আর পাঁচটি ভাল জিনিসের ন্যায়, কমিশনের নজরদারিও অধিক হইলে মুশকিল। নির্বাচনের দিন ঘোষণা হইবার পর সরকারের সমস্ত সিদ্ধান্তই যদি কমিশনের ছাড়পত্রের মুখাপেক্ষী হয়, তবে প্রশাসন অচল হইয়া পড়ে। ডিজেলের দাম বাড়াইবার সিদ্ধান্তটি যেমন। ভর্তুকি হ্রাসের লক্ষ্যে কয়েক মাস পূর্বেই সিদ্ধান্ত হইয়াছিল যে প্রতি মাসে ডিজেলের দাম পঞ্চাশ পয়সা বাড়িবে। নির্বাচনের দিন ঘোষণার পর এই পূর্বনির্ধারিত মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তটিকেও কমিশনের সম্মতিসাপেক্ষ করিবার অর্থ কী? আমলারা সম্ভবত কোনও ‘ঝুঁকি’ লইতে নারাজ। কমিশনই বরং জানাইয়া দিক, এমন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ছাড়পত্রের প্রয়োজন নাই, প্রশাসন নিজের নিয়মে চলুক।

Advertisement

কমিশনের নজরদারিকে যান্ত্রিক ভাবে না দেখিয়া তাহার অন্তর্নিহিত কারণটিকে গুরুত্ব দিলেই এই সমস্যার সুরাহা সম্ভব। ক্ষমতাসীন দল যাহাতে নির্বাচনে অন্যায্য ফসল না তুলিতে পারে, তাহা নিশ্চিত করাই কমিশনের একমাত্র উদ্দেশ্য। অতএব, যে সিদ্ধান্তগুলির সহিত নির্বাচনী সুবিধার সম্পর্ক নাই, সেগুলি লইয়া কমিশনের মাথাব্যথারও কারণ নাই। বস্তুত, নির্বাচনের মুখে ডিজেলের দাম বাড়িলে ক্ষমতাসীন দলের ক্ষতি বই লাভ নাই। তেমনই, ডি কে জোশী ইস্তফা দেওয়ার পর নৌবাহিনীর প্রধান পদে নূতন মুখ নিযুক্ত হইলে শাসক দলের নির্বাচনী লাভ হইবে, কমিশন সম্ভবত তেমন আশঙ্কা করে না। তবুও, নির্বাচনী বিধি প্রযোজ্য হওয়ার কারণে এই সিদ্ধান্তগুলিও কমিশনের ছাড়পত্র বিনা ঠেকিয়া থাকে। এই অবাস্তব, অযৌক্তিক পরিস্থিতি দেশের স্বার্থেই এড়াইয়া যাওয়া প্রয়োজন। দায়িত্ব প্রশাসনের, এবং আরও বেশি কমিশনের। কমিশন বলুক, আমলারা নিজেদের বিবেচনা অনুসারে চলুন। যে সিদ্ধান্ত তাঁহাদের নিকট বেখাপ্পা ঠেকিবে, শুধুমাত্র সেগুলিই কমিশনের বিবেচনার জন্য প্রেরিত হউক। নিছক কাণ্ডজ্ঞান থাকিলেই এই বিচারে ভুল হওয়ার কথা নহে।

তবে, সব সিদ্ধান্তকেই যে এমন সাদা-কালোয় ভাগ করিয়া দেওয়া চলে, তাহা নহে। কৃষ্ণা-গোদাবরী অববাহিকার প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় সরকার করিয়াছিল, নির্বাচন কমিশন তাহা আটকাইয়া দিয়াছে। আপাতদৃষ্টিতে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির সহিত এই সিদ্ধান্তের ফারাক নাই উভয় ক্ষেত্রেই সরকারের অপ্রিয় হইবার সম্ভাবনা। তবে, এই গ্যাসের দাম বাড়িলে ঘুরপথে শাসকদলের লাভ হইবে কি না, কোনও বিশেষ শিল্পগোষ্ঠীর সহিত সরকারের সম্পর্কে কোনও প্রভাব পড়িবে কি না, এই প্রশ্নগুলি উঠিলে একেবারে উড়াইয়া দেওয়া চলিবে না। এমন ধূসর অঞ্চলে কমিশন কী করিবে, তাহা স্থির করিতে হইবে। কিন্তু মাথায় রাখা প্রয়োজন, সব বেনিয়ম ঠেকাইবার দায় বা এক্তিয়ার কমিশনের নাই। নির্বাচনের সহিত যাহার সরাসরি সম্পর্ক নাই, তেমন ক্ষেত্রে সরকার ‘অসদুদ্দেশ্যে’ কিছু করিলে তাহা নিন্দার্হ বটে, কিন্তু সেই নিন্দা করিবার দায় বা সংশোধনের দায়িত্ব কমিশনের নহে। যাচিয়া সেই কাজ করিতে গেলে তাহা অতিসক্রিয়তা হইবে। সেই প্রবণতাটি বিপজ্জনক।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement