শেষ পর্যন্ত তাপস পালই গুরুঠাকুর হইলেন। নির্বাচনী জনসভায় তাঁহার সুভাষিতাবলি গণমাধ্যমে ছড়াইয়া পড়ায় কৃষ্ণনগরের সাংসদ বাম হস্তে ক্ষমাপ্রার্থনার ফুলটি ছুড়িয়া দিয়াছিলেন বটে, কিন্তু তাহা যে কেবল লোক দেখানোর জন্যই, নেত্রী যে প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁহার ভাষা ব্যবহারের অনুরাগী ও অনুগামী, তাহা প্রমাণিত। দলীয় কর্মীদের এক সভায় বিরোধী দলের কোনও এক নেতা সম্বন্ধে বঙ্গেশ্বরী যে শব্দটি প্রয়োগ করিলেন, তাহা ভদ্র সমাজে ব্যবহার্য নহে। তিনি অবশ্য তাঁহার গুরুঠাকুরের তুলনায় অনেক দ্রুত, বস্তুত পরের বাক্যেই, ক্ষমাপ্রার্থনা করিয়া লইয়াছেন। মঞ্চে উপবিষ্ট পারিষদদের সহাস্য করতালি সেই ক্ষমাপ্রার্থনার প্রকৃত অর্থও স্পষ্ট করিয়া দিয়াছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় প্রতি দিনই কোনও না কোনও অতল স্পর্শ করেন। অপভাষার ব্যবহারও সেই তালিকায় যুক্ত হইল। ভাষার ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল ভেদ নাই বলিয়া নেত্রীর এই বচনামৃতকে ‘সাবঅল্টার্ন’ মাহাত্ম্যে প্রতিষ্ঠা করিবার চেষ্টা চলিতেছে, চলিবেও। স্তাবকদের কখনও কুযুক্তির অভাব হয় না। কিন্তু, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে মুখ্যমন্ত্রীর আসনটিকে ফুটপাথে, বিনয় কোঙার-অনিল বসুদের স্তরে, নামাইয়া আনিলেন, সেই সত্যটি কোনও কুযুক্তিতেই ঢাকা পড়িবে না।
অবহিতরা বলিতেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর প্রকাশ্য-বচন হিমশৈলের চূড়ামাত্র। ব্যক্তিগত পরিসরে তিনি ইতরতর ভাষা ব্যবহারে অভ্যস্ত। বস্তুত, অনেকেরই মত, প্রকাশ্যে এমন শব্দ ব্যবহার না করিলেই চলিত ঘরে আড়ি পাতিয়া তো আর কেহ শুনিতেছে না। কেহ কোনও অপশব্দ গণপরিসরে ব্যবহার করিতেছেন কি না, তাহা বিবেচ্য বটে, কিন্তু গৌণ প্রশ্ন। ঘরে ও বাহিরে তো ব্যক্তি বদলাইয়া যায় না। তাহার মন একই থাকে। মুখের কাজ শুধু শব্দটি উচ্চারণ করা, শব্দ ভাবে মন। কাজেই, প্রশ্ন করিতে হইলে তাঁহার মনকে প্রশ্ন করাই বিধেয়। ইহা কেমন মন, যাহা অবলীলায় ইতর শব্দ ব্যবহার করিতে পারে? যে মন রুচির এমন নিকৃষ্ট স্তরে বিরাজ করে, সেই মনই ট্র্যাফিক সিগনালে রবীন্দ্রসংগীত বাজাইবার আদেশ দেয়? গানের বাণীতে মনের এই পাঁক-গন্ধ ঢাকিয়া রাখিতেই কি? কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাপস পালের আস্ফালনে বিচলিত হন নাই, তাহা বোঝা যাইতেছে। তাঁহার মন সেই তারেই বাঁধা, ফলে নায়কপ্রবরের উদ্গার বেসুরে বাজে নাই। তিনি, তাঁহারা এই রাজ্যের কর্ণধার, ভাবিলে অন্তরাত্মা শিহরিত হয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপি-র কোনও নেতার উদ্দেশে শব্দটি ছুড়িয়া দিয়াছেন। সিপিআইএম নির্বিকল্প সমাধিতে, ফলে বিজেপিই আপাতত তাঁহার মূল প্রতিপক্ষ। বিরোধিতা যে তাঁহার সহে না, শাসক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই কথাটি বহু বার প্রমাণ করিয়াছেন। আরও এক বার করিলেন। স্পষ্টতই, গণতন্ত্রে তাঁহার রুচি নাই। গণতন্ত্রের প্রধানতম শর্ত হইল বিরোধীকে বলিতে দেওয়া, তাহার প্রতিটি শব্দকে যথার্থ গুরুত্ব দেওয়া। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পারিলে সম্ভবত অম্বিকেশ মহাপাত্র, শিলাদিত্য চৌধুরী বা সুমন মুখোপাধ্যায়ের ন্যায় বিজেপি নেতাদেরও হাজতে পুরিতেন। তাহা সম্ভব হয় নাই দেখিয়াই হয়তো ক্রোধ অপভাষার রূপ ধারণ করিয়া নির্গত হইতেছে। তিনি তিন দশক ধরিয়া সংসদীয় রাজনীতির মূলধারায় রহিয়াছেন। এত দিনেও তিনি গণতন্ত্রের এই প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ করিতে পারিলেন না দেখিয়া অবাক হইতে হয়। তবে, শিখিবার কোনও বয়স নাই। বিরোধীকে যোগ্য সম্মান দেওয়া, তাঁহাদের প্রতি সহনশীল, সহানুভূতিশীল হওয়ার পাঠ তিনি এখনও লইতে পারেন। জওহরলাল নেহরু নামক মানুষটি তাঁহার সম্পূর্ণ অজ্ঞাত নহেন বলিয়াই অনুমান। তাঁহার জীবন হইতেই শিখুন। শিষ্টতার এমন পাঠ্যক্রম পাইয়াও তাহাকে অস্বীকার করিবার মধ্যে বিচক্ষণতা নাই।