প্রবন্ধ ২

ক্যাম্পাকোলা আবাসন থেকে শাস্ত্রী পার্ক বহু দূর

মুম্বইয়ে অভিজাত বেআইনি নির্মাণ ভাঙনের নোটিস জারির পর গেল গেল রব উঠেছিল। দিল্লির শাস্ত্রী পার্কে বস্তি উচ্ছেদ কাহিনি প্রায় নেই হয়েই আছে। দুই পৃথক সরকারি ভাঙনের কাহিনি। দুই ভারতের কাহিনি।মুম্বইয়ে অভিজাত বেআইনি নির্মাণ ভাঙনের নোটিস জারির পর গেল গেল রব উঠেছিল। দিল্লির শাস্ত্রী পার্কে বস্তি উচ্ছেদ কাহিনি প্রায় নেই হয়েই আছে। দুই পৃথক সরকারি ভাঙনের কাহিনি। দুই ভারতের কাহিনি।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ২২ জুলাই ২০১৪ ০০:২৩
Share:

সূর্যের তেজ কমে এসেছে। এই ধু ধু প্রান্তর যেন এক খন্ডহর। এই সে দিন, রমজান শুরু হওয়ার আগে, ওরা এসে অবৈধ বাড়িগুলো বুলডোজার চালিয়ে ভেঙে দিয়ে গিয়েছে। ওরা মানে দিল্লি ডেভলপমেন্ট অথরিটি। ওরা মানে দিল্লি। ওরা মানে সরকার। ওরা মানে রাষ্ট্র। ওরা মানে প্রভু। ২৫ বছর ধরে একটানা এই এলাকায় বসবাস করেছে এই মানুষগুলো। থাকতে থাকতে শিকড় গজিয়ে গিয়েছিল বস্তিবাসীদের। গত ২৫ জুন হঠাৎই এক যন্ত্রদানব ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেল সেই অবৈধ নির্মাণ। বিজয়পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে ডিডিএ। খুঁটি দিয়ে সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। তাতে লেখা: এই জমি ডিডিএ-র, কেউ অবৈধ ভাবে দখল করতে পারবে না।

Advertisement

ধ্বংসস্তূপের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ঠেকল ভাঙা অ্যানটেনা, টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া রান্নার বাসনপত্র, এমনকী শিশুদের টেক্সট বই, সাইকেল পাখার যন্ত্রাংশ। আর তখনই হঠাৎ মনে হল, মানুষ আসলে অ্যামিবারই মতো। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়েও প্রাণ হারায় না, নব কলেবরে নতুন জীবনের প্রতিষ্ঠা হয়। এই তো রমজান আলির বাসা ভেঙে গিয়েছে, কিন্তু শাস্ত্রী পার্কের মেট্রো স্টেশন সংলগ্ন ফ্লাইওভারের নীচে আবার একটি ঝুপড়ি বানিয়ে ফেলেছেন। ভাই রমজান, কী করেন আপনি? অটো রিকশা চালাই। ওই তো দেখুন আমার অটো রিকশা। দেখলাম, নবনির্মিত এক ঝুপড়ির পাশেই রাখা আছে জীবিকা-যানটি।

কত দিন আছেন এখানে?

Advertisement

তা, তিরিশ বছর তো হবেই। অটো রিকশার মালিক কিন্তু রমজান নিজে নয়। মালিক আলাদা। তবে অনেক দিন ধরে অটো চালানোয় মালিক তাঁকে বিশ্বাস করেন। তাই অটো রিকশাটি তাঁর কাছেই থাকে। রমজানের কাছে নির্বাচনী পরিচয়পত্র আছে। তিনি এ বার লোকসভা নির্বাচনে দিল্লিতে ভোটও দিয়েছেন। আম আদমি পার্টিকে।

ডিডিএ এসে যে এ ভাবে সব ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে, আগাম জানতেন কি ওঁরা?

না না, আমরা কেউই জানতাম না।

খোলা আকাশের নীচে শাড়ি শুকোতে দিয়েছেন রমলা দেবী। রমলা মণ্ডল। বাঙালি। ডায়মন্ড হারবারের। কুড়ি বছর ধরে এখানেই আছেন। লোকের বাড়িতে রান্নার আর কাপড় কাচার কাজ করেন। তিনটি ছেলেমেয়ে রয়েছে। পরিচিত চিত্রনাট্য। স্বামী মাতাল ও লম্পট ছিল। মারধর করত বলে পালিয়ে চলে আসেন রমলা। জানালেন, এই বস্তিতে থাকেন নানা ধরনের মানুষ। মুসলমান আছেন, হিন্দু আছেন। বিহারি বাঙালি সবই আছেন। বাংলাদেশ থেকে আসা বহু মানুষও এখানে আছেন।

অবৈধ ভাবে সরকারি জমি দখল করা তো অন্যায়? কোনও ভাবেই অবৈধ জবরদখলকে সমর্থন করা যায়? এলাকার ‘গ্রাম-প্রধান’ জামালুদ্দিন বললেন, ‘কিন্তু পঁচিশ-তিরিশ বছর ধরে আমরা এখানে রয়েছি। এত দিন তা হলে সরকার কেন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি? উল্টে ভোটের আগে আমাদের পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে। সেখানে এখানকার ঠিকানাও দেওয়া হয়েছে। অনেকের নাকি আধার কার্ড পর্যন্ত হয়ে গিয়েছে এই শাস্ত্রী গেটের ঠিকানায়। কী ভাবে হল? এলাকার কতিপয় দালাল পয়সা নিয়ে কার্ড বানিয়ে দিয়েছিল ওঁদের। তখন সরকার বাহাদুর কি নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন? হঠাৎ ঘুম ভেঙে সরকার চলেছে সমরে?’

বড় জটিল এই চিত্রপট। এই বস্তিতে বিদ্যুৎ ছিল। বেআইনি ভাবে সরাসরি মেন গেট থেকে বিদ্যুৎ টেনে নেওয়া হত। ঘরে ঘরে গ্যাস ছিল। নির্বাচনের আগে সব রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা ভোট প্রচারেও এসেছিলেন। তাই একটি পরিবারও ঘর ভাঙার পরেও এলাকা ছেড়ে চলে যায়নি। উল্টে এলাকাবাসী হাইকোর্ট মামলা করে স্থগিতাদেশ পেয়েছেন। ৩০ জুন শুনানির দিন ছিল। ২ জুলাই দিন পিছিয়েছে। পরবর্তী শুনানি ছিল ১৪ জুলাই। খন্ডহরের মধ্যেই নতুন করে গড়ে উঠছে ঝুপড়ি। জীবন থেমে থাকে না। যে দিন বাড়ি ঘর দোর ভেঙে দিল সে দিন সবাই খুব কেঁদেছিল। অনেক আর্থিক ক্ষতিও হল। এখন চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে। আবার অটো চালাচ্ছেন রমজান, আবার রাজমিস্ত্রির কাজ করছেন সূর্য মণ্ডল।

সংসদ ভবন থেকে মাত্র পনেরো কিলোমিটার দূরে ওই মহল্লা। পাশেই গড়ে উঠেছে শাস্ত্রী পার্ক মেট্রো স্টেশন। মেট্রো রেলের সম্প্রসারণের জন্যই নাকি এই উচ্ছেদ। এখন বস্তিবাসীদের বক্তব্য: এত দিন থেকেছি জমি আমাদের। অতএব সরাতে গেলেও সরকারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। প্রসন্ন গোয়ালিনির কাছে কমলাকান্তের যুক্তি ছিল, দুধ যে খেয়েছে, গরু তার। হাঁটতে হাঁটতেই দেখা হল ম্যাডাম কুসুমরানির সঙ্গে। স্থানীয় এক এনজিও-র নেত্রী বা কর্ত্রী। সংস্থার নাম ‘মাদার’। এই বস্তিতেই ছিল এই সংস্থার দফতর। ডিডিএ সেটিও ভেঙে দিয়েছে। এই অফিস থেকে বসে এই এনজিও জনস্বাস্থ্য পরিচ্ছন্নতার প্রচার চালাত, এমনকী বিনা মূল্যে কন্ডোম বিতরণের মতো জনমুখী কাজও তারা করত। এই ধ্বংসের পর অস্থায়ী ভাবে আবার একটি দফতর করার পরিকল্পনা নিয়েছেন ওঁরা। আপাতত দু’তিনটি বেঞ্চ পেতে দিয়েছেন, ওখানে বসেই আলাপ-আলোচনা চলছে।

এই বিধ্বংসের পরই অবশ্য আপ পার্টির নেতারা এসে এই ক্ষুব্ধ জনতার সঙ্গে দেখা করে বলেন: এর বিহিত চাইতে দিল্লির উপ-রাজ্যপালের কাছে যাবেন তাঁরা। শুরু হয়ে যায় উত্তর-ধ্বংস রাজনীতি। বিজেপির স্থানীয় বিধায়ক অনিল বাজপেয়ীও এসে হাজির: ‘এ হতে পারে না। কেন্দ্রে বিজেপি সরকার থাকলে কী হবে, বিজেপি এই ভাঙন লীলার বিরুদ্ধে।’ অতএব বিজেপি বিধায়ক তাঁদের প্রতিনিধিদের নিয়ে অতিসক্রিয় হয়ে উপরাজ্যপালের কাছে স্মারকলিপি জমা দিতে যান।

কিন্তু খাস রাজধানীতে এমন ঘটনা— সংবাদমাধ্যমে তেমন প্রচার দেখলাম না তো। রাজনীতিতে প্রদীপের নীচেই এত অন্ধকার! অথচ, মনে পড়ে, এই সে দিন মুম্বই শহরে ক্যাম্পাকোলা আবাসনের অভিজাত বেআইনি নির্মাণ ভাঙনের নোটিস জারি হওয়ার পর মিডিয়া জুড়ে গেল গেল রব উঠেছিল। সে যেন এক মহাভারতের যুদ্ধ। কিন্তু দিল্লির শাস্ত্রী পার্কের ভাঙনের কাহিনি প্রায় নেই হয়েই আছে। কেউ কেউ খবর করেছেন বটে, কিন্তু সে নেহাতই ব্যতিক্রম। বেআইনি জবরদখলকারী বস্তি উচ্ছেদ আর ক্যাম্পাকোলা আবাসনের বেআইনি নির্মাণের ভাঙন দুই পৃথক সরকারি ভাঙনের কাহিনি। আসলে, দুই ভারতের কাহিনি।

ভারত নামক দেশটিতে কতগুলি ভারত আছে? মুম্বই শহরে বহুতল বহু-ফ্ল্যাট আবাসনে যাঁরা থাকেন, তাঁরা অভিজাত। তাঁরা বেআইনি নির্মাণের বিরুদ্ধে পাল্টা আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে। আর এই কাজটায় তাঁরা সক্ষম হয়েছিলেন, তার কারণ, সংবদামাধ্যমের একটি বড় অংশ তাঁদের পাশে এসে দাঁড়ান। ২৪ ঘন্টার বার্তা চ্যানেলে সারাক্ষণ আমরা দেখতে বাধ্য হয়েছিলাম কী ভাবে এই অভিজাত সমাজের উপর প্রশাসনিক প্রভুরা খড়্গহস্ত হয়েছেন। তাঁদের হেনস্থার কাহিনি দেখে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল গোটা দেশের নাগরিক সমাজ। আদালতে স্থগিতাদেশ পেতেও তাঁদের সময় লাগেনি। দিল্লির শাস্ত্রী পার্কের অবৈধ বসবাসকারীদের পঁচিশ বছরের বাসস্থানটি বহুতল সিমেন্ট নির্মিত আবাসন নয়। ঝুপড়ি-বস্তি, মাঝেমাঝে কাঁচা পাকা কিছু নির্মাণ। বেআইনি কার্যকলাপ সব সময়ই সকলের জন্যই বেআইনি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের সেই চোরও যেমন চোর, ঠিক তেমনই চোর তিহাড় জেলে থাকা রাজনৈতিক বা কর্পোরেট কর্তারা। কিন্তু দুই চোর কি সমান? হরিপদ কেরানি ও আকবর বাদশায় ভেদটা থেকেই যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন