সম্পাদকীয় ২

খলিফাতন্ত্রের স্বপ্ন

হারুন-আল-রশিদের পর বাগদাদ কি আবার এক জন খলিফা পাইতে চলিয়াছে? ইরাকের সুন্নি জেহাদি নেতা আবু বকর আল-বাগদাদি নিজেকে ইসলামের নূতন খলিফা বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন এবং তাঁহার সংগঠন ‘সিরিয়া ও ইরাকের ইসলামি রাষ্ট্র’ বা আইসিস বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের, বিশেষ করিয়া সকল জেহাদি সংগঠনগুলিকে এই খলিফার আনুগত্য স্বীকার করার আহ্বান জানাইয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৪ ০০:০১
Share:

হারুন-আল-রশিদের পর বাগদাদ কি আবার এক জন খলিফা পাইতে চলিয়াছে? ইরাকের সুন্নি জেহাদি নেতা আবু বকর আল-বাগদাদি নিজেকে ইসলামের নূতন খলিফা বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন এবং তাঁহার সংগঠন ‘সিরিয়া ও ইরাকের ইসলামি রাষ্ট্র’ বা আইসিস বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের, বিশেষ করিয়া সকল জেহাদি সংগঠনগুলিকে এই খলিফার আনুগত্য স্বীকার করার আহ্বান জানাইয়াছে। অটোমান তুর্কিদের দীর্ঘস্থায়ী খলিফাতন্ত্রের অবসানের ঠিক একশত বৎসর পর এই নব্য-খলিফাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস খুবই চিত্তাকর্ষক, সন্দেহ নাই। কিন্তু কল্পনার হিস্টিরিয়া ব্যতীত এই দাবির মধ্যে আর কী আছে, তাহাও তলাইয়া দেখা জরুরি। যে জেহাদিরা নিজেদের বিজয়গর্বে আত্মহারা হইয়া এই দাবি করিতেছে, তাহাদের পিছনে জনসমর্থন আদৌ কতখানি, তাহাও বুঝা দরকার।

Advertisement

সুন্নি জেহাদিরা ইতিমধ্যেই শিয়া-প্রধান ইরাকের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড দখল করিয়াছে। সংলগ্ন সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সুযোগ লইয়া সে দেশেও বিদ্রোহী সংগঠনগুলিকে ক্রমে অপ্রাসঙ্গিক করিয়া দিয়া নিজেরাই শিয়া প্রেসিডেন্ট আসাদের প্রধান প্রতিপক্ষ হইয়া উঠিয়াছে। সেই হিসাবে বাগদাদি কিংবা তাঁহার জেহাদিদের প্রতি শিয়া সম্প্রদায়ের সামগ্রিক আত্মসমর্পণের উপর বহুলাংশে নির্ভর করিতেছে নব্য খলিফাতন্ত্রের এই প্রস্তাব। এই খিলাফত অতএব মুসলিম ‘উম্মা’র সংহতির উপর নয়, তাহার খাড়াখাড়ি বিভাজনের উপর নির্ভরশীল। উপরন্তু সুন্নি গোঁড়ামি অনুশীলনকারী অন্যান্য রাষ্ট্র, যথা সৌদি আরবও বাগদাদির খিলাফতকে শিরোধার্য করিবে, এমন সম্ভাবনা কম। আইসিস-এর সমরভাগ্য যদি অতিশয় সদয় হয়, তাহা হইলে হয়তো ইরাক ও সিরিয়ায়, জর্ডন ও লেবাননে, মিশর ও লিবিয়ায় জেহাদিরা নিজেদের প্রভাব বিস্তার করিতে পারেন। তেমন কোনও সম্ভাবনা আছে কি? ঠিকই, ওসামা বিন লাদেনের নিধন আল-কায়দাকে সম্পূর্ণ অবান্তর একটি সন্ত্রাসী সংগঠনে পরিণত করার পর খলিফা হওয়ার এই চাল জেহাদি বাগদাদিকে কিছু তাৎক্ষণিক সুবিধা দিতে পারে। আল-কায়দার গেরিলা ঘরানার তুলনায় বাগদাদির ইসলামি রাষ্ট্রপন্থীরা অনেক বেশি প্রথানুসারীও বটে। অগণিত প্রশিক্ষণবর্জিত অত্যুৎসাহী স্বেচ্ছাসেবক লইয়া তাহারা নিয়মিত ফৌজ গড়িয়াছে। কিন্তু আইসিস-এর বাহিনী ও প্রশিক্ষণের বিপরীতে আছে তাহাদের অতি-রক্ষণশীলতা ও দমননীতির বাড়াবাড়ি। ইতিমধ্যেই ইরাকের সমস্ত জনপদ খালি করিয়া জনসাধারণ তাহাদের ভয়ে উদ্বাস্তু হইতেছে। খলিফাতন্ত্র এই উপায়ে প্রতিষ্ঠা করা যায় কি না, তাহা একটি বড় প্রশ্ন বটে।

ইতিহাসে যাহাই ঘটিয়া থাকুক না কেন, একবিংশ শতকে কিন্তু খলিফাতন্ত্র নূতন করিয়া প্রতিষ্ঠা করিতে হইলে রীতিমতো বৈপ্লবিক জনসমর্থন লাগিবে। এক দল লড়াই-খ্যাপা জেহাদির তর্জনগর্জনে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইবে না। সিরিয়ার একনায়ক আসাদ এবং ইরাকের শিয়া প্রধানমন্ত্রী নুরি আল-মালিকির সংকীর্ণ রাজনীতির ফলে জেহাদিরা কিছু সাময়িক এবং খণ্ডিত সাফল্য অর্জন করিলেও এমন বৈপ্লবিক সমর্থন তাহারা সত্যই লাভ করিতে পারিবে কি না, বিশেষ সন্দেহ। এই চরমপন্থীরা ভুলিয়া বসিয়াছে, শিয়াসুন্নি গোষ্ঠীবিরোধকে কাজে লাগাইয়া সামরিক সাফল্য পাওয়া যাইতে পারে, কিন্তু বিকল্প শাসন জারি করিতে যে রাজনৈতিক ও নৈতিক বৈধতা দরকার, তাহা অত সহজলভ্য নয়। সমাজ ও রাজনীতি অনেকটা সামনের দিকে অগ্রসর হইয়াছে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন