গঙ্গা-দূষণ রোধের লক্ষ্যে নূতন সরকারের বাজেটে অনেক পরিমাণ অর্থ মঞ্জুর হইল। কেবল অর্থের বন্দোবস্তই নয়, সরকারি উদ্যোগ যে এই বার আগের তুলনায় অধিকতর গুরুতর, তাহার বহু ইঙ্গিত রহিয়াছে। একটি আস্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের দায়িত্ব পাইবার আগে হইতেই মন্ত্রী উমা ভারতী গঙ্গার দূষণমুক্তি লইয়া কাজ করিতেছেন। রাজধানীতে এই মর্মে যে-সম্মেলন অনুষ্ঠিত হইতেছে, তাহাতে বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, ধর্মীয় সাধুসন্তরা, অসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সকলেই একজোট হইয়া দূষণ রোধের বিভিন্ন প্রস্তাব ও পন্থা লইয়া আলোচনা করিতেছেন। এই প্রসঙ্গে যে পরামর্শটি প্রধানত পরিবেশবিদদের নিকট হইতে আসিতেছে, তাহা হইল, এই নদী ব্যবহারকারী সকলকে দূষণরোধের প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা। গঙ্গা ভারতের দীর্ঘতম নদী। দেশের প্রায় ৪০ কোটি মানুষ এই নদীকে ব্যবহার করেন। অথচ নদীকে পরিচ্ছন্ন রাখার কোনও দায় তাঁহাদের নাই। এই দায়বদ্ধতা ফিরাইয়া আনা অতিশয় জরুরি।
গঙ্গা কেবল পুণ্যস্নানের জন্যই ব্যবহৃত হয় না। এই নদীতে টন-টন পূজার ফুল ও অন্যান্য উপচার বিসর্জিত হয়, নদীর ধারে প্রাতঃকৃত্য তো কোটি কোটি লোকের নিত্যকর্ম। তা ছাড়া কুম্ভ মেলা কিংবা ওই জাতীয় কেন্দ্রীয় ধর্মসম্মেলন উপলক্ষে লক্ষ-লক্ষ মানুষের সমাগম যে বিপুল পরিমাণ আবর্জনা নদীর বুকে নিক্ষেপ করে, তাহাতেও কিছু কম দূষণ হয় না। সবার উপরে আছে নদীর ধারে গড়িয়া ওঠা অজস্র কলকারখানার অশোধিত বর্জ্য (যাহার মধ্যে বিষাক্ত রাসায়নিকের পরিমাণ প্রচুর) নিয়মিত নদীর জলে ফেলার অভ্যাস। এই সব বর্জ্য শোধনের জন্য সরকারি পরিকাঠামো নির্মাণে বিপুল অর্থ ব্যয় হইয়াছে। কিন্তু শোধন প্রকল্পগুলি অধিকাংশই অকেজো পড়িয়া রহিয়াছে। যমুনার অবস্থা আরও খারাপ। কেমন করিয়া এই সব সমস্যার নিরসন করা যায়, তাহা বিবেচনা করিতেই ‘গঙ্গা-মন্থন’ সম্মোলেন অনুষ্ঠিত হইতেছে। সম্মেলন কতটা সফল হইবে, তাহা নির্ভর করিতেছে নদীর জল ব্যবহারকারীদের দায়বদ্ধ করিয়া তোলার উপরেই।
পরিবেশবিদরা পরামর্শ দিয়াছেন, মানুষের বর্জ্য আবর্জনার সরাসরি নদী-প্রবেশ রোধ করিতে হইবে। অন্তত ওই বর্জ্য যাহাতে আংশিক ভাবে সংশোধন করা যায়, তাহার উপর জোর দেওয়া চাই। এ জন্য বহনযোগ্য শৌচালয় নদীর তীর বরাবর রাখিয়া দেওয়া যাইতে পারে। দ্বিতীয়ত, যে সব স্থানে ধর্মসম্মেলন উপলক্ষে বিপুল জনসমাগম হইয়া থাকে, সেখানে মানব-বর্জ্য শোধন করার প্রযুক্তিসিদ্ধ প্রকল্প স্থাপন করিতে হইবে। নরেন্দ্র মোদী কিছু কাল আগেই বলিয়াছিলেন, এ দেশে দেবালয়ের চেয়ে শৌচালয়ের প্রয়োজন অনেক বেশি। যথার্থ পর্যবেক্ষণ। তাঁহার সরকার অতঃপর তাঁহার এই বীক্ষা কার্যকর করিতে অগ্রসর হইতে পারে। সর্বোপরি ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে জনচেতনা বৃদ্ধি করা জরুরি। নদী-জল ব্যবহারকারী মানুষদের মধ্যে রোগের প্রকোপ বর্ধমান, অনেক রোগের জীবাণু নিজস্ব প্রতিরোধক্ষমতা বিকশিত করিয়া চিকিত্সা কঠিন করিয়া তুলিতেছে। দূষণরোধের প্রক্রিয়া যথাযথভাবে কার্যকর করিলে এই বেকারত্বের দেশে বহু মানুষের কর্মসংস্থানও হইতে পারে। যেমন নদীতে নিক্ষেপিত ফুল সংগ্রহ করা এবং তাহা হইতে সুগন্ধি কিংবা কম্পোস্ট সার তৈয়ারির কাজে অনেক লোককে নিয়োগ করা যায়। আসলে প্রয়োজন গুরুত্বসহকারে এবং স্বচ্ছতার সহিত পরিকল্পনাগুলির রূপায়ণ।