গণতন্ত্রের এত পচনের মধ্যেও এখনও জনমতের ভূমিকা আছে

নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক গুরুত্ব যেমন আগের থেকে অনেক বেড়েছে, তেমনই রাজনৈতিক দলগুলির একনায়কতন্ত্র, স্বেচ্ছাচারিতা, নির্বাচনে দুর্নীতিও একই ভাবে বেড়েছে। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালগোটা দেশ এখন ভোট নিয়ে ব্যস্ত। কোটি কোটি টাকা উড়ছে। কে বেশি খরচ করছে, তা নিয়েও কলহ চলছে। নির্বাচন কমিশন পৃথিবীর তথাকথিত বৃহত্তম গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে ব্যস্ত। ত্রিশ বছরের সাংবাদিকতায় এই শাহি দিল্লিতে অনেকগুলি লোকসভা ভোট দেখলাম, অনেক প্রধানমন্ত্রীও দেখলাম। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, রাজধানীর রাজনীতি যেন আমজনতা থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০০
Share:

নয়াদিল্লিতে নির্বাচন কমিশনের সদর দফতর।

গোটা দেশ এখন ভোট নিয়ে ব্যস্ত।

Advertisement

কোটি কোটি টাকা উড়ছে। কে বেশি খরচ করছে, তা নিয়েও কলহ চলছে। নির্বাচন কমিশন পৃথিবীর তথাকথিত বৃহত্তম গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে ব্যস্ত। ত্রিশ বছরের সাংবাদিকতায় এই শাহি দিল্লিতে অনেকগুলি লোকসভা ভোট দেখলাম, অনেক প্রধানমন্ত্রীও দেখলাম। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, রাজধানীর রাজনীতি যেন আমজনতা থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।

টি এন শেষনের বই ‘ভারতের অধঃপতন’। সেখানে প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার লিখেছেন, ১৯৭৫ সালে রায়বরেলী থেকে শ্রীমতী ইন্দিরা গাঁধীর নির্বাচন অনৈতিক পন্থা অবলম্বনের অভিযোগে হাইকোর্ট বাতিল করে দেয়। তিনি হাইকোর্টের সেই রায় মেনে নিতে অস্বীকার করেন। তখন থেকে নির্বাচনে পচন ধরল। তা থেকেই এল অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা। সংসদের আয়ু বাড়ানো হল। বিরোধী নেতারা গেলেন জেলখানায়। খবরের কাগজের উপর এল সেন্সর ব্যবস্থা।

Advertisement

আসলে গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে যখন অবক্ষয় গ্রাস করতে শুরু করে, তখন তার কয়াল ছায়া নির্বাচন কমিশনের উপরেও এসে পড়তে বাধ্য। জওহরলাল নেহরু প্রধানমন্ত্রী হলে স্বাধীনতার পর যখন প্রথম নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়, তখন নেহরু কি এমনটা ভেবেছিলেন? ভারতের প্রথম নির্বাচন কমিশনার ছিলেন এক বঙ্গসন্তান। সুকুমার সেন। মানুষটি ছিলেন গণিতজ্ঞ। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র। নেহরু তাঁকে এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন। নির্বাচন কমিশনের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ব্যাপ্তি ছিল তখন অনেক সীমিত। কতিপয় অফিসার মিলে সে দিন কমিশনকে চালাতেন। আর সেই কমিশনের ভূমিকা আজ কী হল, ভাবা যায়?


টি এন শেষন


জওহরলাল নেহরু


রাজীব গাঁধী

এ দেশে নির্বাচন কমিশন অবশ্য প্রথম থেকেই স্বাধীন ভাবে কাজ করতে চেয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কখন অনুষ্ঠিত হবে, সে বিষয়ে কমিশনের সঙ্গে কদাচিত পরামর্শ করা হত। সরকার কমিশনকে জানিয়ে দিত, কোন সময়ে তারা ভোট চায়। সরকারের কথা কমিশন অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিত। তার এ দিক ও দিক করার কোনও ক্ষমতা কমিশনের ছিল না। সে দিক থেকে দেখতে গেলে এখন কিন্তু কমিশনের হাতেও অনেক ক্ষমতা। রাজীব গাঁধীর সময়ে আমি দিল্লিতে এসে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দেখেছিলাম পেরী শাস্ত্রীকে। তখনও কিন্তু সরকারের সঙ্গে কমিশনের কোনও সংঘাত বাধেনি। যেন মনে হত, সরকারেরই অধীন একটি দফতর হল নির্বাচন কমিশনের বাড়িটা। টি এন শেষনই প্রথম নির্বাচন কমিশনার, যিনি বোঝালেন এই সাংবিধানিক সংস্থাটির গুরুত্ব কতখানি।

এক দিকে যেমন নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক গুরুত্ব আগের থেকে অনেক বেড়েছে, আবার এটাও ঘটনা, রাজনৈতিক দলগুলির একনায়কতন্ত্র, স্বেচ্ছাচারিতা, নির্বাচনে দুর্নীতিও একই ভাবে বেড়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, ইন্দিরা গাঁধীর জরুরি অবস্থা যে শুধু অল্প সময়ের জন্য দানা বেধেছিল, তা নয়, আসলে জরুরি অবস্থার প্রভাব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপরে প্রবল ভাবে পড়ে। এর ফলে আজও সমস্ত গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলির একটি চূড়ান্ত অবক্ষয় হয়েছে। বিচার ব্যবস্থা থেকে সংবাদমাধ্যম, সরকারি এবং বেসরকারি, সাংবিধানিক ও অসাংবিধানিক নানা ধরনের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কিন্তু ঘুণ ধরেছে। টি এন শেষনকে নিয়ে যখন সরকার নাজেহাল হয়ে যায়, তখন ১৯৯৩ সালের ১ অক্টোবর সরকার আরও দু’জন নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ করিয়ে প্রত্যাঘাত করল। ওই দুই কমিশনার ছিলেন এম এস গিল, যিনি এক সময় কৃষি রসায়ন সচিব ছিলেন। আর এক জন ছিলেন জি ভি কে কৃষ্ণমূর্তি, যিনি একদা আইন কমিশনের সদস্য ছিলেন।


দেশের প্রথম নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন

এই ঘটনায় নির্বাচন সদনে উথালপাতাল শুরু হয়ে যায়। আজ যেমন কেজরীবালকে সংবাদ মাধ্যমের একটি বড় অংশ কিছু দিন আগেও সমর্থন করেছে, ঠিক সেই ভাবে সে দিন টি এন শেষনকেও সংবাদ মাধ্যম বিরাট ভাবে সমর্থন করেছে। তবে মনে রাখতে হবে, এটা কিন্তু নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য প্রথম প্রচেষ্টা নয়, ১৯৮১ সালে রাজীব গাঁধী সরকার দু’জন নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ করেছিল। রাজীব গাঁধী শাসনের অবসান আর বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহের ক্ষমতা লাভের প্রাক্কালের ঘটনা। সেই দু’জন কমিশনার ছিলেন এম এস ধানোয়া এবং ভি এস সেগেল। টি এন শেষন তখন ক্যাবিনেট সচিব।

পেরী শাস্ত্রীর মতো শান্তিপ্রিয় এক ব্যক্তিকেও তৎকালীন সরকার সহ্য করতে পারেনি। তিনি টি এন শেষনের কাছে এসে বলেন, এটি কী ধরনের সিদ্ধান্ত? শেষন তাঁকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমার পরামর্শ নেননি। পেরী শাস্ত্রী আবার বলেন, রাজীব গাঁধী কী ভেবেছেন নিজেকে? শেষন তাঁর বইতে জানিয়েছেন, তাঁর জবাব ছিল, তিনি বোধহয় ভেবেছেন তিনি প্রধানমন্ত্রী। ভি পি সিংহ ক্ষমতায় এসে এই নিয়োগ বাতিল করে দেন। সরকারের বিরুদ্ধে ধানোয়া সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। সুপ্রিম কোর্ট সেই আপিল নাকচ করে। নরসিংহ রাও রাজীব জমানার সেই ইতিহাস কিন্তু ফিরিয়ে আনেন।

আসলে রাজনৈতিক নেতারা যখন ক্ষমতাসীন হন, তখন বোধহয় তাঁদের মধ্যে ঘুমন্ত একনায়কতন্ত্র জেগে ওঠে। হিটলারের মনস্তত্ত্ব নিয়ে সম্প্রতি একটি বই পড়ছিলাম। মনস্তাত্ত্বিক লেখক ওয়াল্টার সি লেঙ্গার তাতে দেখিয়েছেন, কী ভাবে প্রবল জনসমর্থন হিটলারকে হিটলার করে তোলে। একটা ভিড়তন্ত্রের দেবতা হয়ে তখন হিটলাররা মনে করতে শুরু করেন, তিনি যেটা বলবেন, সেটাই আইন। তাঁর কথাতেই চলবে নির্বাচন কমিশন। তাঁর কথাতেই চলবে সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, সিবিআই, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট ইত্যাদি। আসলে প্রধানমন্ত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী, সকলেই একটি সাংবিধানিক চৌহদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ। ভারতের মতো একটি বিশাল দেশে গণতন্ত্রের এত পচনের মধ্যেও, ক্ষমতার এত অপব্যবহার, এত দুর্নীতির মধ্যেও তবু মনে হয় এখনও জনমতের একটা ভূমিকা আছে। এখনও দেশের প্রত্যন্ত গ্রামের কোনও ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে মানুষ পালাবদলের পালার প্রধান কারিগর।


এখনও পালাবদলের পালার প্রধান রূপকার আমজনতা।

গায়কের ব্যর্থতার জন্য তো আর গানকে দোষারোপ করে লাভ নেই। সংসদ কতটা শক্তিশালী বা কতটা দুর্বল হবে, সেটা নির্ভর করে প্রশাসনিক প্রভুরা তাঁকে কতটা মান্য করবে, তার উপরে। খোদ অম্বেডকর ১৯৪৯ সালের ১৮ মে গণ পরিষদের বিতর্কে যোগ দিয়ে বলেছিলেন, ১৯৩৫ সালের আইনের বলে যে সব প্রাদেশিক আইন সভা কাজ করছে, সেগুলি আমি খুব ভাল করে লক্ষ করছি। এমন কয়েকটা প্রদেশের কথা আমি জানি (আমি নাম করতে চাই না) যেখানে সারা বছরের মধ্যে ১৮ দিনের বেশি আইন সভার অধিবেশন হয়নি। আমাদের ধারণা হয়েছিল, এই অবস্থা হলে সেটি হবে গণতন্ত্রের বিকৃতি। এখন আবহাওয়া বদলে গিয়েছে। এখন আর সরকারি প্রশাসন আইনসভাকে অবহেলা করতে পারবে না।

কিন্তু আজ এত বছর পরেও হতাশ লাগে, উৎকোচ আর অযোগ্যতা গণতন্ত্রের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রার্থী ছিল ৯ হাজার। টি এন শেষন বলছেন, ওই ভোটে খরচ হয়েছিল প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। জওহরলাল নেহরু বড় মুখ করে বলেছিলেন, হাতের কাছে যে ল্যাম্পপোস্টটি পাবেন, তাতে অসাধু ব্যবসায়ীদের ফাঁসিতে ঝোলাবেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে যে টাকা খরচ হচ্ছে, যে ভাবে জনমতকে প্রভাবিত করার জন্য সংবাদ মাধ্যম ও জনসংযোগকে ব্যবহার করা হচ্ছে, যে ভাবে সব দল উন্নয়ন ও গণতন্ত্র ভুলে বেশি বেশি করে জাতপাত আর ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে চাইছে গ্রামে-গঞ্জে, তাতে রচনার উপসংহারে লেখার জন্যও আশার আলো ছড়িয়ে দিতে ব্যর্থ হচ্ছি।

প্রশ্ন একটাই, বাস্তবতার দোহাই দিয়ে নিরাশাবাদ ছড়ানো কি লেখকের অন্যায়? না কি মিথ্যা আশার বাণীকে বাধ্যতামূলক উপসংহার করা পাঠকের সঙ্গে মিথ্যাচার?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন