সম্পাদকীয় ১

চাঁদমারি

আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের মনসবদাররা নিশ্চয়ই ভাবিতেছেন, আজ তোমার পরীক্ষা, ভগবান, থুড়ি মার্কসবাদ। নবান্ন অভিযানের খণ্ডযুদ্ধের পর আজ ধর্মঘটে যদি সত্যই জনজীবনে প্রভাব পড়ে, তবে তাঁহারা বুঝিবেন, এখনও প্রাণ আছে। যাঁহারা জীবনমরণের চৌকাঠে দাঁড়াইয়া আছেন, তাঁহাদের খুঁত ধরিতে নাই। তবে, কেহ প্রশ্ন করিতেই পারেন, শক্তিপরীক্ষার ধর্মঘটে শ্রমিকদের নাম না জড়াইলেই কি চলিতেছিল না?

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০৩
Share:

আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের মনসবদাররা নিশ্চয়ই ভাবিতেছেন, আজ তোমার পরীক্ষা, ভগবান, থুড়ি মার্কসবাদ। নবান্ন অভিযানের খণ্ডযুদ্ধের পর আজ ধর্মঘটে যদি সত্যই জনজীবনে প্রভাব পড়ে, তবে তাঁহারা বুঝিবেন, এখনও প্রাণ আছে। যাঁহারা জীবনমরণের চৌকাঠে দাঁড়াইয়া আছেন, তাঁহাদের খুঁত ধরিতে নাই। তবে, কেহ প্রশ্ন করিতেই পারেন, শক্তিপরীক্ষার ধর্মঘটে শ্রমিকদের নাম না জড়াইলেই কি চলিতেছিল না? ভারতে শ্রমিক সংগঠনের সহিত শ্রমিকদের প্রকৃত স্বার্থের সম্পর্ক অতি ক্ষীণ। সংগঠনগুলি রাজনৈতিক দলের পরিবর্ধিত অংশ বই কিছু হইয়া উঠিতে পারে নাই। ঐতিহাসিক ভাবেই শ্রমিক সংগঠন রাজনৈতিক জবরদখলের অতি পরিচিত জমি। কোনও দল জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়া শ্রমিক সংগঠন দখল করিয়াছে, কোনও দল সর্বহারার মহান নেতা হইয়া উঠিবার তাত্ত্বিক অত্যুৎসাহে। যে দলগুলি অপেক্ষাকৃত পরে খেলিতে নামিয়াছে, তাহারাও পিছাইয়া থাকে নাই। শ্রমিক সংগঠনের অস্তিত্বের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখিবার কথা কেহ ভাবেন নাই। দলের নেতা এবং সংগঠনের নেতারা এক ও অভিন্ন হইয়াছেন। ফলে, কোনও প্রশ্নে শ্রমিক সংগঠনের স্বার্থ এবং দলের রাজনৈতিক স্বার্থ যদি বিপ্রতীপ হয়, শ্রমিকের স্বার্থটি জলাঞ্জলি দেওয়াই দস্তুর।

Advertisement

বর্তমান ধর্মঘটেও দল শ্রমিকদের কথা ভাবিবার অবকাশ পায় নাই। যে বারো দফা দাবি লইয়া ধর্মঘট, তাহার অধিকাংশই শ্রমিকের— অতএব, শ্রমিক সংগঠনেরও— স্বার্থবিরোধী। নেতারা নূতন কর্মসংস্থানের দাবি জানাইয়াছেন, আবার শ্রম আইন সংশোধনের বিরোধিতাও করিয়াছেন। এমন দুইটি পরস্পরবিরোধী লক্ষ্যে একই সঙ্গে তিরনিক্ষেপ করিবার কথা ভাবিতে বিলক্ষণ কল্পনাশক্তি প্রয়োজন। শ্রম আইনটি যুগোপযোগী না হইলে বিনিয়োগ আসিবে না, ফলে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাও ক্ষীণতর হইবে। অবশ্য, বাম নেতাদের সম্ভবত বিনিয়োগেও আপত্তি। তাঁহাদের দাবির তালিকায় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণের বিরোধিতা আছে, রেল-বিমা-প্রতিরক্ষার ন্যায় ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের বিরোধিতাও রহিয়াছে। তাঁহারা শ্রমিকের বেতন বাড়াইবার দাবি করিয়াছেন, কিন্তু তাহার জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের পথ বন্ধ করিবার কথাও উচ্চারণ করিয়াছেন একই নিঃশ্বাসে। সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি কোথাও বাঁচিয়া থাকে, তবে তাহা ভারতীয় বামপন্থী নেতাদের মনে। কিন্তু, সেই মনে শ্রমিকের ঠাঁই নাই। রাজনীতির দাবার ছকে তাঁহারা বড় জোর তাৎপর্যহীন বোড়ে। রাজনৈতিক দলগুলি যে আদৌ শ্রমিকের স্বার্থরক্ষায় উৎসাহী নহে, তাহার হাতেগরম প্রমাণও রহিয়াছে। কর্পোরেট ভারতের কর্মীরা রাজনৈতিক দল-চালিত ট্রেড ইউনিয়নের দখলে থাকা কারখানার কর্মীদের তুলনায় সর্ব অর্থেই ভাল রহিয়াছেন। সেখানে অন্তত কেহ শ্রমিকের স্বার্থরক্ষার ছলে নিজস্ব রাজনৈতিক চাঁদমারিতে তির চালনা করে না।

বামপন্থী নেতারা বলিতে পারেন, শ্রমিক সংগঠনে তাঁহাদের দখলদারি নেহাত অকারণ নহে। শ্রমিকদের রাজনৈতিক ভাবে সংগঠিত না করিলে পুঁজির সহিত তাঁহারা পাঞ্জা লড়িতে পারিতেন না। সর্বহারার স্বার্থেই তাঁহারা অগ্রপথিক হইবার গুরুদায়িত্ব বহন করিয়াছেন। শ্রমিকের হইয়া কথা বলিবার গুরুদায়িত্ব নিজেদের স্কন্ধে তুলিয়া লইতে হইলে নিজস্ব স্বার্থগুলি পার্টি অফিসেই রাখিয়া আসা উচিত ছিল। বিশেষত, দুই পক্ষের স্বার্থে যখন বিরোধ রহিয়াছে। অগ্রপথিক হইবার পূর্বশর্ত হইল নিজস্ব স্বার্থ না থাকা। নচেৎ, দুই স্বার্থের মধ্যে সংঘাত হইলে কোনটি গুরুত্ব পাইবে, তাহা অনুমেয়। ভারতের শ্রমিক সংগঠনের ইতিহাস সেই স্বার্থের সংঘাত ও পরবর্তী চয়নের চলমান আখ্যান। আজ তাহাতে আরও একটি অধ্যায় যোগ হইতেছে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন