প্রবন্ধ ২

চা বাগানের শ্রমিকরা যে ভাবে বেঁচে আছেন

সমীক্ষা বলছে, উত্তরবঙ্গের চা বাগানগুলিতে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি। মানুষ অনাহারে মারা যাচ্ছেন। শিক্ষা বা চিকিত্‌সার প্রাথমিক ব্যবস্থাটুকুও নেই।উত্তরবঙ্গের ন’টি সংগঠিত চা-বাগান: রেড ব্যাঙ্ক, সুরেন্দ্রনগর, ধরণীপুর, ঢেকলাপাড়া, বান্দাপানি, মধু, রহিমাবাদ, পটকাপাড়া, রায়পুর বেশ কিছু দিন ধরে বন্ধ, রুগ্ণ, নয় অনিয়মিত ভাবে চালু। এর মধ্যে ঢেকলাপাড়া বন্ধ বিগত বারো বছর।

Advertisement

অশোককুমার মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৫ ০০:০০
Share:

অতঃপর? বন্ধ হয়ে যাওয়া রায়পুর চা বাগানের শ্রমিকরা। জুন, ২০১৪। ছবি: সন্দীপ পাল।

উত্তরবঙ্গের ন’টি সংগঠিত চা-বাগান: রেড ব্যাঙ্ক, সুরেন্দ্রনগর, ধরণীপুর, ঢেকলাপাড়া, বান্দাপানি, মধু, রহিমাবাদ, পটকাপাড়া, রায়পুর বেশ কিছু দিন ধরে বন্ধ, রুগ্ণ, নয় অনিয়মিত ভাবে চালু। এর মধ্যে ঢেকলাপাড়া বন্ধ বিগত বারো বছর। চা-শ্রমিকরা প্রভিডেন্ড ফান্ড, গ্র্যাচুইটি বাবদ তাদের ন্যায্য প্রাপ্য পাননি। অনাহারে মৃত্যু ঘটে চলেছে শ্রমিক পরিবারে। গত ছ’মাসে রায়পুরে মৃত ছয়, বান্দাপানিতে ২২, রেড ব্যাঙ্ক গ্রুপে মোট ৪৬। গত চার বছরে ঢেকলাপাড়াতে মৃতের সংখ্যা ৩৯। এই শ্রমিকদের অধিকাংশই আদিবাসী, যাদের পূর্বপুরুষকে ব্রিটিশ রাজত্বে লাগানো হয়েছিল বন সাফ করে চা-বাগান বানানোর কাজে।

Advertisement

চালু ব্যবস্থায়, ডুয়ার্স-তরাই অঞ্চলে চা-শ্রমিকের দিনমজুরি ৯৫ টাকা, দার্জিলিঙে ৯০ টাকা। টি প্ল্যান্টেশন লেবার অ্যাক্ট (১৯৫১) অনুযায়ী, মজুরি ছাড়াও আনুষঙ্গিক সুবিধা হিসেবে প্রত্যেকের প্রাপ্য ভর্তুকির রেশন, নির্দিষ্ট পরিমাণ জ্বালানি কাঠ, বিনামূল্যে আবাসন, পানীয় জলের জোগান, চিকিত্‌সা-সুবিধা। অনূর্ধ্ব ১২ বছরের সন্তানদের জন্য প্রাইমারি স্কুলের বন্দোবস্ত। বাগানে দৈনন্দিন কাজ করার জন্য প্রত্যেকের ৭২ গজ থান কাপড় পাওয়ার কথা। কিন্তু রাজ্যের বেশির ভাগ চা-বাগানে এই সব সুবিধা নেই।

মালিকপক্ষ বলেন, তাঁরা আনুষঙ্গিক সুবিধা হিসেবে যা দেন, টাকার অঙ্কে তার মূল্য শ্রমিক পিছু ৬৭ টাকা, অর্থাত্‌ ডুয়ার্স-তরাইয়ের চা-শ্রমিকের আসল দিনমজুরি ধরতে হবে মোট ১৬২ টাকা। কিন্তু আসলে এই আনুষঙ্গিক সুবিধার মূল্য ৩৪ টাকা। যখন কৃষিশ্রমিকদের ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি ২১৬ টাকা, শিল্প-শ্রমিকদের দিনমজুরি এর থেকে বেশি হওয়া প্রয়োজন। সরকারি হিসাব এবং সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী এই দিনমজুরি হওয়া উচিত ৩২৪ টাকা, যা ওই ১৬২ টাকার দ্বিগুণ।

Advertisement

অনতইতীতে ডুয়ার্স-তরাই-পাহাড়ের আঞ্চলিক লেবার কমিশনার দফতর থেকে এলাকার ২৭৬টি চা-বাগানের ২৭৩টি-তে এক সমীক্ষা চালানো হয়। ১০ মে ২০১৩ প্রকাশিত সমীক্ষাপত্রে পাওয়া গেল অন্তত ১০টি বঞ্চনার ছবি। এক, আড়াই লক্ষেরও বেশি শ্রমিকের মধ্যে এখনও ৯৫,৮৩৫ জন ঘর পায়নি। দুই, প্রায় ত্রিশ হাজার বাড়িতে বিদ্যুত্‌ সংযোগ নেই। তিন, মাত্র ৬১টি চা-বাগানে পানীয় জলের ব্যবস্থা আছে। চার, চিকিত্‌সার ব্যবস্থা আছে মাত্র ১০৭টি চা-বাগানে। পাঁচ, ১৭৫টি চা-বাগানে কোনও লেবার ওয়েলফেয়ার অফিসার নেই। ছয়, ক্যান্টিন নেই ১২৫টি বাগানে। সাত, স্কুল নেই ৪২টি চা-বাগান মহল্লায়। আট, ১৮টি চা-বাগান শ্রমিকদের প্রাপ্য প্রভিডেন্ট ফান্ড খাতে টাকা জমা দেয়নি। নয়, ৪৬টি বাগান এক পয়সাও গ্র্যাচুইটি দেয়নি শ্রমিকদের। দশ, কোনও রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেখাতে বা জমা দিতে পারেনি ৮৭টি চা-বাগান।

এমন বঞ্চনা যেখানে, অনাহার-অপুষ্টিজনিত মৃত্যু হবেই। শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্বে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হবেই। হচ্ছেও। কলকাতাবাসীদের কাছে ওই মৃত্যু এবং প্রতিবাদ দুই-ই যেন গা-সওয়া হয়ে গেছে। চুপচাপ অনাহারে মারা যাওয়া অচেনা, নামগোত্রহীন আদিবাসীদের জন্য আমাদের সহানুভূতি কতটাই বা জেগে ওঠে? কিন্তু, কখনও দিনের পর দিন অনাহারে চোখের সামনে বউ-বাচ্চাকে মারা যেতে দেখে, নারীপাচার চক্রের খপ্পরে পড়ে পরিবারের মেয়েদের নিখোঁজ হতে দেখে (ইউনিসেফ-এর রিপোর্টে দেখছি, ২০১০-এ রেড ব্যাঙ্ক গ্রুপের এক চা-বাগান থেকে নিখোঁজ তিনশোর বেশি নারী), তারা খেপে উঠে যদি কোনও বাগান-ম্যানেজারকে পিটিয়ে মেরে দেয়, তখন আমাদের যাবতীয় বিবেক জেগে উঠে ব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রতিবাদ করতে। সংবাদমাধ্যমে বয়ে যায় সহানুভূতির বন্যা। হিংসা মানে কি শুধু দৈহিক নিগ্রহ, রক্তপাত? লাগাতার বঞ্চনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে ছিন্নভিন্ন করা, অনাহারে মেরে ফেলা হিংসা নয়?

দার্জিলিং-জলপাইগুড়ির পাঁচটি সংগঠন— শিলিগুড়ি ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশন, জলপাইগুড়ি ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশন, ডুয়ার্স জাগরণ, ফোরাম ফর পিপলস হেল্থ আর সৃজন— ডাঃ বিনায়ক সেন আর তাঁর পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ-এর সহযোগে অনাহার-অপুষ্টি পীড়িত চা-বাগানে সমীক্ষার কাজ হাতে নেয়। অপুষ্টি-অনাহারের কবলে রয়েছে কি কোনও জনগোষ্ঠী? তারা কি দুর্ভিক্ষের কবলে? এটা বোঝার জন্য মান্য সূচক হল বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই)। এই সংখ্যা যদি ১৮.৫-এর নীচে হয়, বুঝতে হবে তার ওজন স্বাভাবিকের কম— সে অনাহার, অপুষ্টিতে আছে। কোনও জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশের বেশি মানুষের বিএমআই ১৮.৫-এর তলায় থাকলে, ডব্লুএইচও-র সংজ্ঞা অনুযায়ী, সেখানে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি। এই তত্ত্বের নির্ভরে প্রথম সমীক্ষা হয়েছিল জুলাই ২০১৪-তে রায়পুর চা-বাগানে। ২০১২ থেকে রায়পুর বন্ধ। সমীক্ষকরা যাওয়ার আগে মারা গিয়েছিলেন ৬ জন চা-শ্রমিক। সরকারি মহল থেকে বলা হয়েছিল, কেউ অনাহারে মারা যায়নি। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুযায়ী যাকে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি বলে, তা-ই বিরাজমান ওই বাগানে।

তার পরে আবার বিগত কয়েক মাস ধরে চালানো হয় তুলনায় বড় সমীক্ষার কাজ। সংগঠনগুলি উত্তরবঙ্গের রেড ব্যাঙ্ক, বান্দাপানি, ডায়না, কাঁঠালগুড়ি, ঢেকলাপাড়া এবং রায়পুর চা-বাগানে অনুসন্ধান চালায়। ওই সব বাগান থেকেই মৃত্যুর খবর আসছিল। সমীক্ষায় দেখা গেল, যা ভাবা গিয়েছিল, বাস্তব অবস্থা তার থেকে অনেক খারাপ। খাবার নেই, বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারে না, চিকিত্‌সার ব্যবস্থা নেই। কেউ কেউ নদীর বুকের পাথর ভেঙে খুবই সামান্য রোজগার করেন। তা দিয়ে খাওয়া চলে না। অতএব, অপুষ্টি, অনাহার।

এই ফেব্রুয়ারি মাসে সমীক্ষায় পাওয়া কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা গেল। বন্ধ থাকা রায়পুর চা-বাগানে ১২৭২ জনের বিএমআই পরীক্ষায় দেখা যায়, ৫৩৯ জনের (অর্থাত্‌ পরীক্ষিত গোষ্ঠীর ৪২ শতাংশ) ক্ষেত্রে তা ১৮.৫-এর কম। অতএব, এরা দুর্ভিক্ষপীড়িত। কোনও সন্দেহ নেই, এঁরা অনাহারে মারা যাচ্ছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিএমআই যাদের ১৭ এবং ১৬, তাদের মারা যাওয়ার হার ১৮.৫-এর তুলনায় যথাক্রমে দেড় গুণ, দু’গুণ বেশি। রায়পুর চা-বাগানে পরীক্ষিতদের মধ্যে ৩৮৪ জনের (অর্থাত্‌ পরীক্ষিত গোষ্ঠীর ৩০ শতাংশ) বিএমআই ১৭, ২৮৫ জনের (২২ শতাংশ) ১৬-র নীচে, আর ১৪০ জনের (১১ শতাংশ) ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ১৪-র কম। অন্যান্য সব বন্ধ চা-বাগানের অবস্থা কমবেশি একই রকম।

চা-শ্রমিকদের দুর্দশার খবর জোগাড় এবং তা যুক্তির নির্ভরে বৃহত্তর জনসমাজে ছড়িয়ে দিয়ে তাঁদের পাশে টেনে নিতে, দার্জিলিং-জলপাইগুড়ির বন্যাত্রাণ করা হিতবাদী সংগঠনের সঙ্গে জুড়ে গেছে মানুষের অধিকার নিয়ে লড়তে থাকা সংগঠন, স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে মাথা ঘামানো মানুষ। জনজাতির ভালমন্দ নিয়ে কাজ করে যাওয়া কয়েক জনের সঙ্গে এসে গেছে সাংস্কৃতিক কর্মীদের সংগঠনও।

কলকাতার নাগরিক সমাজও যত দ্রুত শিখে নেয় এই নতুন পথ, পাথুরে প্রমাণ হাতে কুযুক্তি প্রতিহত করবার বিজ্ঞান, ততই মঙ্গল। কান পাতলেই শোনা যায়, শহরের তেতে-পুড়ে থাকা মানুষ বিরক্ত গলায় সব পরিচিত রঙের ভোটপার্টির উদ্দেশে বলছেন— ‘সব দল সমান’ অথবা ‘যে যায় লঙ্কায়, সে-ই হয় রাবণ’।

অর্থাত্‌, মানুষই চাইছে নতুন পথ। অচেনা পথ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন