অ রুন্ধতী ভট্টাচার্য ঠিক বলিয়াছেন। কৃষিঋণ মকুব করিলে ঋণ শোধ করিবার অভ্যাস নষ্ট হয়। ক্ষতি হয় কৃষির ও কৃষকের। স্টেট ব্যাঙ্কের প্রধানের এই বক্তব্যের পক্ষে বিস্তর সাক্ষ্য-প্রমাণ ইতিমধ্যেই মিলিয়াছে। কিন্তু তাহাতে রাজনৈতিক নেতাদের কানে জল ঢোকে নাই। তাই শাসক ও বিরোধী উভয় পক্ষ শোরগোল তুলিয়াছে। কংগ্রেস মহারাষ্ট্র বিধানসভায় তাঁহার বিরুদ্ধে অধিকার ভঙ্গের নোটিস আনিল। উত্তরপ্রদেশে কৃষিঋণ মকুব করিবার যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বিজেপি দিয়াছিল, তাহা পূরণ করিতে উদ্যত। মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকেও কৃষিঋণ মকুবের দাবিতে শোরগোল চলিতেছে। ভোট-বুভুক্ষুদের এই অপরিণামদর্শিতার কি শেষ নাই? ১৯৯০ সালে উপপ্রধানমন্ত্রী দেবী লাল, ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ চাষির ঋণ মকুব করিয়াছিলেন। প্রতিবারই স্পষ্ট হইয়াছে, ভোট আসিলেই ফের ঋণ মকুব হইবে, এই আশায় চাষিদের একটি বড় অংশ পরবর্তী বৎসরগুলিতে কৃষিঋণ শোধ করিতে বিলম্ব করেন। ফলে চার-পাঁচ বৎসর পরেও বিপুল কৃষিঋণ অনাদায়ী থাকিতেছে বিভিন্ন জাতীয় ব্যাঙ্ক ও সমবায়গুলির। অর্থনীতির বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যাঙ্কের সহিত চুক্তি খারিজ করিতে পারেন রাজনৈতিক নেতা, এই বিশ্বাস সর্বাধিক ক্ষতিকর। কারণ, তাহা বাণিজ্যিক লেনদেনের ভিত্তিটিই নস্যাৎ করিয়া দেয়। রাজকোষের বিপুল অপচয়ের চাইতেও ভয়ানক এই অনাস্থা-জনিত ক্ষতি। ঋণ ছাড়ের অর্থমূল্য যত অধিক হইবে, চাষির ঋণ-খেলাপের সম্ভাবনাও ততই বাড়িবে, ইহা বিশ্বব্যাঙ্কের একটি সমীক্ষায় স্পষ্ট হইয়াছে। গণতন্ত্রের জন্যও ইহা ক্ষতিকর। সুদ মকুব করিবার দাবিকে ভোটপ্রাপ্তির শর্ত করিয়া তোলা সুস্থ নির্বাচনী গণতন্ত্রের পরিচয় নহে।
অথচ কৃষিঋণ মকুব করিলে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষির কোনও সুবিধাই হয় না, বরং তাঁহাদের ঝুঁকি বাড়ে। কারণ, ব্যাঙ্ক ছাড়িলেও মহাজন ছাড়ে না। নাবার্ডের একটি রিপোর্ট (২০১৪) বলিতেছে, বিভিন্ন রাজ্যে মহাজন তথা অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের উপর নির্ভরশীল চাষি ৫৭-৭৭ শতাংশ। তাহাদের সুদের হারও অতি চড়া। শুধু ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই নয়, চাষের জন্যও মহাজনের উপর নির্ভর করে চাষি। অতএব রাজকোষ হইতে কয়েক হাজার কোটি টাকা গুণাগার দিয়েও চাষিদের সামান্যই উপকার করিতে পারে সরকার। অপর দিকে, টাকার অভাবে কৃষি সমবায়গুলি ঝাঁপ বন্ধ করিতেছে। খেলাপি ঋণের বোঝা বাড়িতে থাকায় জাতীয় ব্যাঙ্কগুলি কৃষিঋণ দিতে অনাগ্রহ দেখাইতেছে। ফলে চাষি আরও বেশি মহাজন-নির্ভর হইতেছে। বিদর্ভের ন্যায় সংকটপূর্ণ এলাকাগুলিতে সরকার কৃষিঋণের সুদে ছাড় দিয়া, ঋণশোধের সময়সীমা বাড়াইয়াও চাষির আত্মহত্যা রোধ করিতে পারে নাই। তাহার কারণ মহাজনের চড়া সুদ হইতে নিষ্কৃতি নাই চাষির। ঋণ মকুব করিয়া চাষিকে স্বস্তি দিবার চেষ্টা করিতে গিয়া সমবায় ও ব্যাঙ্কগুলির ক্ষতি করা গোড়া কাটিয়া আগায় জল দিবার শামিল।
বাস্তবিক চাষির উপকার করিতে চাহিলে প্রশ্ন করিতে হইবে, ব্যাঙ্কের ঋণ শোধ করিবার অক্ষমতাই কি তাহার প্রধান সমস্যা? তাহার উত্তর, না। যাঁহাদের ঝুঁকি সর্বাধিক, সেই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের প্রধান সমস্যা ব্যাঙ্ক বা সমবায়ের সহিত সম্পর্কহীনতা। তাঁহারাই সংখ্যায় অধিক, কিন্তু ভারতে মোট কৃষিঋণের মাত্র সিকিভাগ জোটে তাঁহাদের। জমিহীন ঠিকাচাষির সংখ্যা বাড়িতেছে, কিন্তু তাঁহাদের সমবায়-সংযুক্তি ঘটে নাই। চাষির সহমর্মী হইলে গ্রামীণ ব্যাঙ্ক ও কৃষি সমবায়গুলিকে আরও শক্তিশালী করিয়া তাহাদের বিস্তার বাড়াইতে হইবে। ঋণ মকুব, সুদ মাফ করিবার জনমোহিনী নীতি ছাড়িয়া, ছোট চাষির নিকট ব্যাঙ্কের ঋণ সহজলভ্য করা প্রয়োজন। অর্থনীতির বিপরীতে অবস্থান নেয় যে রাজনীতি, তাহা গরিবের কাজে লাগিবে না।