বাত্সরিক উত্সব। বাজেট বক্তৃতা চলছে। মোরাদাবাদ, উত্তরপ্রদেশ, ১০ জুলাই, ২০১৪। ছবি: পিটিআই।
পি চিদম্বরমের বাজেটের সঙ্গে অরুণ জেটলির বাজেটের তফাত কতটা?
সাংঘাতিক কোনও তফাত নেই। তবে কতকগুলো জায়গায় কিছু নতুন ব্যাপার আছে। গুজরাত অর্থনীতির মডেল থেকে কিছু জিনিস এই বাজেটে আনা হয়েছে। যেমন বনবন্ধু কল্যাণ যোজনা। কিংবা গ্রাম এবং শহরের সমন্বয়ের ভিত্তিতে ‘রারবান’ উন্নয়নের কথা আছে। আর, সাধারণ ভাবে কয়েকটা বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। যেমন, নগরায়ণ। কিংবা তথ্যপ্রযুক্তি এবং পরিকাঠামো। এবং, অবশ্যই প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই), যা নিয়ে অন্তত কিছুটা এগোনোর কথা বলা হয়েছে। এই সবগুলোই আপাতত প্রস্তাব। এবং, আগের সরকার যে এ-সব নিয়ে কিছুই বলেনি তা-ও নয়, কিন্তু এই ধরনের ব্যাপারে যে ঝোঁক বা জোরটা এ বার দেখা গেল, সেটা নিশ্চয়ই লক্ষ করার মতো।
বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যা বলা হয়েছে, বিমা বা প্রতিরক্ষায় এফডিআইয়ের ঊর্ধ্বসীমা ২৬ থেকে ৪৯ শতাংশ করার প্রস্তাব সেটা কতটা ফলপ্রসূ হতে পারে?
প্রথম কথা, ‘স্টেটমেন্ট অব ইন্টেন্ট’ হিসেবে এর একটা মানে আছে। সেটা দরকারিও বটে। তবে কাজের কাজ কতটা হবে, তা নানা ব্যাপারের ওপর নির্ভর করে। যেমন, বিমায় বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব কার্যকর করার জন্য আইন সংশোধনের দরকার। আবার, প্রতিরক্ষার কোন কোন ক্ষেত্রে এফডিআই আসতে দেওয়া হবে, সেটাও ক্রমশ প্রকাশ্য। তার পরে তো কতটা লগ্নি সত্যিই আসবে, সেই প্রশ্ন উঠবে।
বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য পিপিপি (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ) মডেলের ব্যাপারটাও কি সে-রকমই? স্টেটমেন্ট অব ইন্টেন্ট?
পিপিপি নানা ধরনের হয়। তার মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি সমন্বয়ের ভিত্তিতে নতুন সম্পদ সৃষ্টি করার প্রকল্প নিয়েই প্রধানত কথা হচ্ছে। এখন, এ ধরনের প্রকল্পের ক্ষেত্রে একটা বড় প্রশ্ন হচ্ছে, টাকা কোথা থেকে আসবে? সাধারণত এই সব প্রকল্পের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের টাকা উসুল করতে করতে অন্তত বছর কুড়ি কেটে যায়। মুশকিল হল, ব্যাঙ্কঋণ তো এত দীর্ঘমেয়াদে পাওয়া যায় না। এ ছাড়া, জমি সংগ্রহ করার সমস্যা ইত্যাদি নানা প্রশ্ন তো আছেই।
তা হলে এই বাজেটে আয়বৃদ্ধির কতটা সুরাহা হতে পারে?
এই বাজেটে সরাসরি আয়বৃদ্ধির জন্য খুব কিছু নেই। তার হয়তো দরকারও নেই। আয়বৃদ্ধির জন্য সরকারের যা করণীয়, সেটা আলাদা ভাবে করা যায়, হয়তো তা করা হবেও। আসলে, বাজেটে বড় বড় সংস্কারের কথা থাকল কি না, সেটা নিয়ে আমাদের দেশে অনেক হইচই করা হয় বটে, কিন্তু বাজেটের নিজের দিক থেকে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ, বাজেট হল প্রধানত সরকারি আয় এবং ব্যয়ের হিসেব। সুতরাং, এই দুটি ক্ষেত্রে কী করা হচ্ছে, কতটা পরিষ্কার করে সরকারি লক্ষ্য, নীতি ও কার্যক্রমের কথা বলা হচ্ছে, আমার কাছে সেটাই যে কোনও বাজেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক।
সেই দিক থেকে এই বাজেট কেমন হল?
দুটো কথা বলতে চাই। এক, কর ব্যবস্থার সংস্কারের আরও বিশদ পরিকল্পনা আশা করেছিলাম। বড় করদাতাদের সমস্যা সুরাহা করতে কিছু কিছু উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু তার পাশাপাশি ছোট ছোট করদাতাদেরও অনেক সমস্যা, অনেকেই অনেক মামলায় জড়িয়ে আছেন, তার সমাধানও জরুরি। দুই, ডিরেক্ট ট্যাক্স কোড (ডিটিসি) এবং পণ্য পরিষেবা কর (জিএসটি), দুটিরই তো লক্ষ্য হল কর ব্যবস্থার সরলীকরণ, যাতে দেশে একটা পরিষ্কার কর এবং শুল্কের কাঠামো বলবত্ হয়। কিন্তু সেটাই যদি লক্ষ্য হয়, তা হলে শুল্কের কাঠামোয় এখনও এত খুচরো খুচরো পরিবর্তন করা হবে কেন? এই ধরনের পরিবর্তন মানে তো আসলে সরকার নিজের হাতে অনেকখানি ক্ষমতা ধরে রেখে দিচ্ছে। সেটা কিন্তু সংস্কারের মূল দর্শনের বিরোধী। সংস্কারের আসল মানে হল, বিভিন্ন নীতি বা পদ্ধতি পরিবর্তনের ক্ষমতা সরকারের হাতে যথাসম্ভব কম রাখা।
আর সরকারি ব্যয়?
সরকারি ব্যয়ের কতটা কোন খাতে করা হবে, সেটা নিশ্চয়ই সরকারের সিদ্ধান্ত। সেটাই অগ্রাধিকারের প্রশ্ন। অগ্রাধিকার নিয়ে তর্ক হতেই পারে। কিন্তু সেই সব তর্কের নিষ্পত্তি করে একটা স্পষ্ট এবং সরল ব্যয়কাঠামো তৈরি করাই তো সরকারের কাজ। তা হলে এত খুচরো খুচরো প্রকল্প কেন? বাজেটে ডজন ডজন প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছে, প্রত্যেকটা একশো কোটি টাকার। এর মানেটা কী? এ দিক থেকে কেউ বলতেই পারেন, চিদম্বরমের সঙ্গে অরুণ জেটলির মিল আছে!
বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা কতটা? রাজকোষ ঘাটতি সত্যিই ৪.১ শতাংশে বেঁধে রাখা যাবে?
আমার মনে এ বিষয়ে প্রশ্ন আছে। মূল অঙ্কটা নিয়েই প্রশ্ন। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের তৈরি অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০১৪-১৫ সালে জিডিপির অর্থমূল্য (মূল্যবৃদ্ধি সহ) বাড়বে ১৩.৪ শতাংশ। আমার মনে হয় না এতটা বাড়বে। এখন, জিডিপির বৃদ্ধি যদি এর চেয়ে কম হয়, তার অনুপাতে রাজকোষ ঘাটতির অনুপাত বাড়বে। পরের দু’বছরে যে রাজকোষ ঘাটতির অনুপাত (৩.৬ ও ৩ শতাংশ) দেখানো হয়েছে, তা নিয়েও একই সংশয়।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, কর এবং জিডিপির অনুপাত বাড়ানো দরকার। অথচ বাজেটে আয়করের ক্ষেত্রে প্রচুর ছাড় দেওয়া হয়েছে। হিসেব মিলবে কী করে?
আগে একটা কথা বলে নিই। কর ব্যবস্থার দক্ষতা এবং সমতা, দু’দিক থেকেই পরোক্ষ করের তুলনায় প্রত্যক্ষ করের অনুপাত বাড়ানো উচিত। কিন্তু এই বাজেটে, প্রধানত মধ্যবিত্তকে খুশি করার জন্য, প্রত্যক্ষ করে ছাড় দেওয়া হয়েছে, বাড়ানো হয়েছে পরোক্ষ করের হার। সেটা না হলেই ভাল হত। এ বার, কর এবং জিডিপির অনুপাত সম্পর্কে বলি, বাজেটে এই অনুপাত ধরা হয়েছে ১০.৬ শতাংশ। প্রথমত, সেটা খুব আহামরি কিছু নয়। দ্বিতীয়ত, প্রকৃত জিডিপি যথেষ্ট বাড়লে রাজস্ব বাড়বে, এটা ধরে নিয়ে এই অনুপাত কষা হয়েছে। সুতরাং, আয়বৃদ্ধি কতটা হবে, তার ওপর প্রকৃত ফলাফল নির্ভর করবে।
ভর্তুকি নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা কতটা?
সারের ভর্তুকি আনুপাতিক ভাবে খুব বেশি নয়। পেট্রোলিয়মের ক্ষেত্রে কিছুটা কাজ আগেই হয়েছে। এখন প্রধান সমস্যা রান্নার গ্যাস এবং কেরোসিন নিয়ে। এই দুটি ক্ষেত্রে ভর্তুকি কতটা কমানো যাবে, সংশয় আছেই। আর আছে খাদ্য ভর্তুকি। এ ক্ষেত্রে রাজ্যের সঙ্গে আলাপ আলোচনা, বোঝাপড়া, সমন্বয় খুব জরুরি, কারণ খাদ্য নিরাপত্তার ব্যবস্থাটা চালানো হয় রাজ্য স্তরেই। কিন্তু সেই সমন্বয়ের কতটা কী করা হবে, কী ভাবে করা হবে, বাজেটে তার স্পষ্ট দিশা নেই।
এক কথায় বললে?
বাজেটকে আমাদের দেশে একটু বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেটা আগেই বলেছি। কিন্তু এটাও ঠিক যে, এই বাজেট নিয়ে একটা বাড়তি আশা ছিল, কারণ নতুন সরকার, নতুন নেতৃত্ব, ইত্যাদি। সেই আশা ঠিক মিটল না। নির্দিষ্ট করে বললে, কর, সরকারি ব্যয় এবং রাজকোষ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে খুব সুস্পষ্ট পরিকল্পনা থাকলে ভাল হত। সেটাই বাজেটের কাজ। এমন ঢাউস বাজেট বক্তৃতায় অবশ্য সেটা সম্ভবও নয়। প্রায় আড়াইশো অনুচ্ছেদ, পড়তে দু’ঘণ্টার বেশি সময় লাগে! দরকার ছিল তীক্ষ্ণ, মেদবিহীন, সুস্পষ্ট বাজেট ভাষণ। সেটা পাওয়া গেল না।