ফেসবুক মানবজীবনের মুখচ্ছবিটি পাল্টাইয়া দিয়াছে। ফেসবুক-প্রেমী হইতে শুরু করিয়া ফেসবুক-বিদ্বেষী সকলেই একবাক্যে স্বীকার করিবেন। গর্বিত প্রবর্তক মার্ক জুকেরবার্গ তো করিবেনই। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও যে ফেসবুকের সপক্ষে বলিতে শুরু করিয়া তিনি ইহার নেতিবাচক দিকগুলিকে এত যত্ন করিয়া আলোচনা করিলেন, তাহা দৃষ্টান্তস্বরূপ হইয়া থাকিল। গ্লোবাল কমিউনিটি বা বিশ্ব-জনসমাজ লইয়া তাঁহার যে ভাবনা, না কি স্বপ্ন, এই সুদীর্ঘ ম্যানিফেস্টো ফুটাইয়া তুলিয়াছে, পাঠকদের তাহা নূতন করিয়া ভাবাইতে বাধ্য। নূতন জনসমাজ তৈরির কথা তো কত স্বপ্নদ্রষ্টাই ভাবিয়াছেন, কত সমাজ-সংস্কারকই ভাবিয়াছেন, শেষ পর্যন্ত কি তাঁহাদের সকলের স্বপ্ন সফল হইয়াছে? সাফল্যের নিরিখে তাই সামাজিক স্বপ্নের গুরুত্ব মাপা চলিবে না। সেই মান মাপিতে হইবে অন্তর্নিহিত আদর্শ বা দর্শন দিয়া। জুকেরবার্গের দলিলটি নিশ্চিত ভাবে সেই দিক হইতে ঐতিহাসিক। ইহাতে যে বিভিন্ন প্রকার ভবিষ্য-সমাজের স্বপ্নচিত্র প্রজ্বলিত হইয়াছে, তাহা বিবেকবান ও শুভবোধসম্পন্ন মানুষমাত্রকেই আবিষ্ট করিবে। ভাবিত এবং উদ্দীপ্ত করিবে।
ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে কত রকম সম্মিলন সম্ভব, জুকেরবার্গ সূত্র দিয়াছেন। ‘সাপোর্টিভ’ কমিউনিটি বা ‘ইনফর্মড’ কমিউনিটির ধারণাগুলিই বুঝাইয়া দেয়, মানুষ চেষ্টা করিলেই যে উচ্চতায় পৌঁছাইতে পারে, তাহা হইতে কত দূরে কত অনাবশ্যক আত্মকেন্দ্রিকতা ও আত্মপ্রবঞ্চনার মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ার অধিবাসীরা ডুবিয়া থাকেন। কী খাইতেছি পরিতেছি এমনকী ভাবিতেছি, ইহা অপেক্ষা কত উচ্চতর লক্ষ্যে এই সংযোগকে ব্যবহার করা যায়, ‘আমি’ হইতে বাহির হইয়া অন্য স্তরের দায়বদ্ধতায় উত্তীর্ণ হইতে পারে, তাহা গোড়া হইতে ফিরিয়া ভাবিতে হয়। রবীন্দ্রনাথে পড়া ‘ছোট আমি’ আর ‘বড় আমি’র দ্বৈততা মনে পড়ে। ইহা কি একটি বিরাট সদর্থক সুযোগ নয়? মানুষে মানুষে বিভেদ বিচ্ছেদ কমাইয়া এক সম্মেলক দায়বদ্ধতায় পৌঁছাইবার সম্ভাবনা নয়? জুকেরবার্গ উদাহরণ দিয়াছেন কী ভাবে কোনও দুর্ঘটনার পর বিপুল সঙ্ঘবদ্ধতায় তাহার মোকাবিলা করা গিয়াছে, কিংবা কোনও ব্যক্তির সংকট বহু দূর হইতে সহজে মিটানো গিয়াছে। সত্য বলিতে, যৌথ সিদ্ধান্তগ্রহণ বা যৌথ দায়িত্বগ্রহণের যে স্তরে সোশ্যাল মিডিয়া পৌঁছাইয়া দিতে পারে, তাহার অন্য বিকল্প কি জানা আছে? আর, মানবিক সঙ্ঘবদ্ধতা সদর্থে কাজে লাগিবে, না অসদর্থে, উদার লক্ষ্যে ব্যবহার হইবে না সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধিতে, তাহা তো শেষ পর্যন্ত মানুষের প্রবণতার উপরই নির্ভর করিবে! প্রবণতা কি প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণে? পড়ি নাই কি স্কুলপাঠ্য বইতে— বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ?
সুতরাং প্রবণতাই স্থির করিয়া দেয়, খবর কী ভাবে ‘তৈরি’ করিতে হয়, ‘মিথ্যা’ কী ভাবে ‘সত্য’ হিসাবে উপস্থাপন করিতে হয়, ‘পোস্ট-ট্রুথ’ দুনিয়ায় কত কুটিল উদ্দেশ্য সত্যরূপ মিথ্যা হাসিল করে। প্রায় এক হাজার শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন জুকেরবার্গ ‘ফেক নিউজ’-এর উদ্বেগতাড়নায়। সেনসেশনালিজম–এর প্রতি অদম্য টান কী ভাবে আটকানো যায়, তিনিও জানেন না। তবে তিনি এইটুকু জানেন যে কোনও খবরের শিরোনামের শিহরনটুকুতে গ্রস্ত না থাকিয়া যদি খবরের মূল বিবরণে মনোনিবেশ করা যায়, ছোট লক্ষ্যের বদলে যদি ঈষৎ বড় লক্ষ্য শিরোধার্য করা যায়, হয়তো তরল ও বিপজ্জনক সেনসেশনালিজম হইতে কিছুটা রক্ষা সম্ভব। ‘আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স’ ব্যবহার করিয়া কি প্রযুক্তি কিছু প্রতিকার আশা করিতে পারে? পারে, ফেসবুক-পিতার মত: ভবিষ্যৎ সেই পথ দেখাইবে। কিন্তু পথ তো কেবল প্রকরণ। উদারতা ও সদিচ্ছা নামক মানবিক উত্তরণ ছাড়া সেই প্রকরণ কী কোনও কাজে লাগিবে?
যৎকিঞ্চিৎ
ফ্রান্সে পুলিশ রাত্রিবেলা রাস্তায় শোওয়া রিফিউজিদের লাঠি মেরে উঠিয়ে দিল, কেড়ে নিল তাদের কম্বল বা স্লিপিং ব্যাগ, আর বলল, ফ্রান্স ছেড়ে চলে যা! এমন একটি দেশে এ কাণ্ড ঘটল, যাদের জগদ্বিখ্যাত মন্ত্র হল, সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা। ধরে ধরে অসাম্য বৈরিতা পরাধীনতা করে দিলেও খুব ভুল ঘটবে না। মাইনাস সাত ডিগ্রি ঠান্ডায় কারও গা থেকে কম্বল কেড়ে নেওয়া যায়? বুড়ো বাচ্চা সব্বার? বোধ হয় ফ্রান্সের শৈত্যে সহন শেখাচ্ছিল পুলিশ, ‘সহনশীলতা’র অন্য সংজ্ঞা দিয়ে!