একটা সময় ছিল যখন কালো-সাদা টিভির পর্দায় একটি মাত্র চ্যানেলে বিনোদনের ব্যবস্থা করা হত। সবাই বলতেন, বিনোদন ব্যবসার বেসরকারিকরণ হলে আরও অনেক উন্নত হবে বিনোদনের স্তর, আসবে অনেক কোম্পানি, অনেক শিল্পী, অনেক বিষয় ইত্যাদি। অর্থাৎ, প্রতিযোগিতার ফলে অনেক উন্নত হবে টিভি-বিনোদনের বাজার। যেমনটা হয়ে থাকে প্রতিযোগিতা ও গুণমানের লাগাতার দৌড়ের ফলে। কালে কালে আমরা রঙিন টেলিভিশন পেলাম, টেলিভিশনে অনেক নতুন নতুন চ্যানেল পেলাম, চ্যানেলে চ্যানেলে অনেক ধরনের বিনোদনের আনন্দ উপভোগে অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম। কিন্তু ধীরে ধীরে অন্য একটা সমস্যা দানা বাঁধল— যার থেকে সহজে মুক্তি নেই।
টিভির পর্দায় যে বিষয়ের উপরে ভিত্তি করে বিনোদন বস্তু তৈরি হয়, সেই গল্পগুলো, তাদের চরিত্রায়ণ, সে-সব চরিত্রের কথাবার্তা দেখেশুনে আতঙ্কিত এবং আশঙ্কিত হওয়া ছাড়া গতি নেই। যে কুসংস্কারকে দূর করার জন্য মানুষ ধীরে ধীরে শিক্ষা লাভ করে উন্নত হয়, সেগুলোই বেশ কিছু সময় হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সব বিনোদনীর অপরিহার্য উপাদান। তুকতাকে বিশ্বাস, সিঁদুর মুছে গেলে বা শাখা ভেঙে গেলে বিপদ-আপদের ঝড়, এক-একটি চরিত্রের দানব-দানবী সদৃশ ব্যবহার, যাতে জনপ্রিয়তা বাড়ে। মানুষের মধ্যে এমন অনেক বিসদৃশ জান্তব অনুভূতি থাকে, যা মানুষ শিক্ষা ও চেতনার সাহায্যে অব্যক্ত রাখে, সেগুলো থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু বিনোদনের এই বাজার তাকে তা করতে দেয় না। এবং এই অশুভ অনুভূতিগুলো এমন ভাবে বহু মানুষকে গ্রাস করছে, যা সরাসরি পারিবারিক, সামাজিক কাঠামোয় আঘাত করছে। অনেক বাড়িতে এখন সন্ধের পর ব্যক্তিগত আতিথেয়তার ব্যাপারটা এক চরম বিপদের মুখে দাঁড়িয়েছে। পুরনো সামাজিক আদানপ্রদানের জায়গায় নতুন ‘অ-সামাজিক’ বিনোদন, প্রিয়জনের মধ্যে চিরন্তন এবং কিছু শুভ সম্পর্কের জায়গায় এমন কিছু উপাদানের প্রাচুর্য, যা দেখলে চেনা মানুষগুলোকে আর চেনা যায় না।
এর পিছনে বাজারের একটা ভূমিকা অবশ্যই আছে। বিনোদনের বাজার যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁরা কিন্তু অন্য যে-কোনও দ্রব্যের বাজারের মতোই এটাকে ব্যবহার করেন। ম্যানেজমেন্টে পারদর্শী কোনও কর্তাব্যক্তি বা ধনী ব্যবসায়ী দেখেন যে, পটল ফলালে কত মুনাফা আর বিনোদন ব্যবসায় নামলে কত। বিনোদন ব্যবসা বেশি পয়সা দিলে তাঁরা সেটাই করবেন, এটাই অর্থনীতির কথা। তাতে যদি সামাজিক সম্পর্ক, স্বাভাবিক এবং উন্নততর চেতনা কিংবা কুসংস্কার থেকে মুক্তি— সব কিছু গোল্লায় যায়, পরোয়া নেই। আলু-পটলের বা ভূষি মালের ব্যবসা থেকে বিনোদন ব্যবসার যে একটু অন্য তাৎপর্য থাকা উচিত, তার শৈল্পিক দিকটা ছাড়াও ঠাকুরের কথায় ‘লোকশিক্ষা’র ব্যাপারটাও থাকে, সে বিষয়ে বাজারের মাথাব্যথা নেই।
আজকাল ভোটের যুগ। বিনোদন শিল্পকেও ভোট দেন মানুষ। যে যত ভোট পাবে, তত রেটিং বাড়বে, ততই বিপণনের সম্ভাবনা বাড়বে। যখন টিভিতে বেসরকারি চ্যানেলকে নিয়ে আসা বা বিনোদন ব্যবসায় বেসরকারিকরণের কথা বলা হয়েছিল, তখন অনেকের বাড়িতে টিভি ছিল না। এখন আয় বৃদ্ধির কারণে, বিশেষ করে বিগত দুই দশকে ভারতীয় জাতীয় আয় বৃদ্ধির হারে বেশ খানিকটা উন্নতি হওয়ায় অনেক নিম্নবিত্ত মানুষও টিভি কিনছেন। মনে রাখতে হবে, অনেক ক্ষেত্রেই আয় যতটা বেড়েছে, শিক্ষার মান ততটা বাড়েনি। প্রশ্ন হল, এর ফলে বিনোদনের চাহিদার চেহারা-চরিত্রটা কেমন দাঁড়িয়েছে? সোজা কথায় বললে, বিনোদনের বাজারে গুণের কদর কি অনেক কমে গেছে? শৈল্পিক গুণমান, চেতনার কিঞ্চিৎ উন্নয়ন, ভাল-মন্দের খানিকটা সূক্ষ্ম বিচার যে শুধু কেতাবি শিক্ষার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, তা নয়। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, শিক্ষা এবং চিন্তা করার ক্ষমতা মানুষের চাহিদার গুণমানকে উন্নত করে। এখন অনেক মানুষ বিনোদন ব্যবসাকে জিইয়ে রেখেছেন, তার উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে, কিন্তু গুণমানের কথা বলতে গেলে হতাশায় নিমজ্জিত হওয়ার কারণ আছে বইকী। অন্য ভাবেও এই অপ্রিয় সত্যের প্রমাণ মিলেছে। কিছুকাল আগেই দেখা গিয়েছিল, দু’একটি উচ্চমানের প্রযোজনা বেশ ভাল হতে হতে হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে, কারণ রেটিং তেমন বাড়েনি বা কমে গিয়েছিল। এই লেখার উদ্দেশ্য সংখ্যাগরিষ্ঠকে অশ্রদ্ধা করা নয়, কিন্তু ‘আমি অধম বলে আপনি উত্তম হবেন না কেন’, সেটাও তো ভাবা দরকার।
আমরা ছোটবেলায় স্কুলে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বইয়ে পড়েছি, গণতন্ত্রের জনপ্রিয়তার রাজনৈতিক দিকটা অতীব মনোগ্রাহী বটে, কিন্তু এর প্রভাবে সংস্কৃতির পরিসরে নিম্নমানের আধিপত্য বিস্তারের সম্ভাবনা অত্যন্ত প্রবল। মনে পড়ে আমার এক পুরনো মাস্টারমশাইয়ের কথা। তিনি এক সময় গভীর সমাজবাদী হওয়ার চেষ্টা করছেন। আমাকে বললেন যে, শাস্ত্রীয় সংগীত চর্চার সঙ্গে সঙ্গে আমি গণসংগীত চর্চা করি না কেন। তিনি বা তাঁর মতো লোক গণসংগীত বলে যেটা ভাববেন, সেটা চটজলদি জনপ্রিয় হয়ে যেতে পারে, কিন্তু তাঁকে বোঝাতে পারিনি, গণসংগীতের যথার্থ সাধনায় সেই চর্চাজনিত সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগের কাজ চলে আসবে, সেই গণসংগীত তখন অত জনপ্রিয় হবে না।
সত্য এই যে, ভোট দিয়ে বা নিয়ে শিল্প-সংস্কৃতি কোনওটাই হয় না। যা হয়, এখনকার বিনোদন ব্যবসা তার একটা বিরাট উদাহরণ। মুশকিল হল, কুংস্কারকে জিইয়ে রাখতে পারলে ভোটের জোগান কোনও দিন কমবে না, কারণ কুসংস্কার কিংবা মানুষের অবচেতনার কদাকার দিককে টিভির পর্দায় আমরা তো দেখতেই চাই। অথচ, চাই বলেই তো সেগুলোর পরিমার্জনা দরকার। কিন্তু সে কাজ করে কে? সরকার বাহাদুর আমাদের দেশে অনেক অ-কাজে অনর্থক নাক গলান, কিন্তু একটা বড় কাজ কখনও করেন না। বিদেশের পাবলিক ব্রডকাস্টিং সিস্টেম-এর মতো কিছু চ্যানেল তৈরি করেন না, কারণ তাতে ভোট নেই। সবাই সব রকম সিদ্ধান্তের আগে ‘ভোট’টা দেখে নিচ্ছেন। সরকারের চালকরাও।
শেষে একটা কথা বলা ভাল। বিনোদন ব্যবসায় যাঁরা দিন-রাত কাজ করেন, তাঁদের অবস্থা কিন্তু তেমন সুবিধের নয়। কুসংস্কার আর অশুভবুদ্ধি বেচে বিনোদনের বাজারে শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে, কিন্তু এ ব্যবসায়ের শ্রমিকশ্রেণি, কর্মী, অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীর অধিকারের জায়গাটাও বেশ দুর্বল। প্রতিযোগিতা ও বাজার যে রকম জোরকদমে এগোচ্ছে, তার সঙ্গে এগোচ্ছে রঙিন হাতছানিতে আসক্ত প্রচুর কর্মীর জোগান। ফলে যা হয় তা-ই হচ্ছে।
এ বিষয়েও সরকার বাহাদুরের প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণের হাত বাড়ানো ভীষণ ভাবে উচিত। ফ্যাক্টরি অ্যাক্ট-কে বিনোদন ব্যবসায় ঠিক ভাবে বলবৎ করা উচিত। শুধু বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠী বা বিশেষ দলেদের গোঁসা হল কি না তা দেখলে চলবে না।