সমীক্ষায় প্রকাশ পাইল, ভারত তাহার প্রতিবেশী দেশগুলির তুলনায় ‘সুখ সূচক’-এ পিছাইয়া আছে। সমীক্ষাটি আরও বলিল, সমগ্র বিশ্বে এই সুখ-সূচকের ভিত্তিতে রচিত তালিকায় ভারত গত বৎসরে ছিল ১১৮তম স্থানে, এই বৎসর নামিয়া গিয়াছে ১২২তম স্থানে। পৃথিবীর সুখীতম দেশ বিবেচিত হইয়াছে নরওয়ে, আর অসুখীতম দেশ কেন্দ্রীয় আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র। এই ধরনের তালিকাকে বহু মানুষই সন্দেহের চক্ষে দেখেন, সুখ কোনও ক্রীড়া নহে যে ইহার স্পষ্ট জয়ী-পরাজিতের বিভাজন সম্ভব, এবং সুখের অব্যয় সংজ্ঞা নিরূপণও অসম্ভব। তবে এই ক্ষেত্রে কয়েকটি নির্দিষ্ট মাপক ছিল: আয়, প্রত্যাশিত আয়ু, সংকটকালে নির্ভর করিবার মানুষ, উদারতা, স্বাধীনতা ও বিশ্বাস। ইহার মধ্যেও কিছু শব্দ ভিন্ন মানুষের নিকট ভিন্ন দ্যোতনা বহন করিতে পারে। স্বাধীনতা কাহাকে বলে? অন্তত বাক্স্বাধীনতা লইয়া বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ভিন্ন মত বিদ্যমান, সন্দেহই নাই। আর বিশ্বাস? পদবি ব্যতীত আর কোনও রূপে তাহা ইদানীং স্পষ্ট অবয়ব ধারণ করে না।
কেহ ভাবিতেছেন, ভারত বিমর্ষ হইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু বিষাদ ও অ-সুখ সর্বদা সমার্থক নহে। কেহ হয়তো প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষী, সে যাহা পাইয়াছে তাহা অনেক, কিন্তু সে আরও অনেক চাহে। সে ধনী, নিজ কার্যক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, সাংসারিক জীবনেও ঝঞ্ঝাটহীন। কিন্তু সে এখনও নিজ প্রত্যাশার মানচিত্রে অভিযান শুরুই করে নাই। এই মানুষটি বিষণ্ণ কখনওই নহে, সে অস্থির, বিরক্ত, অতৃপ্ত। কিন্তু তাহার জীবন পূর্ণ হইয়াছে পরিকল্পনা ও অনুপ্রাণিত কর্মে, সে সতত পরবর্তী প্রতিষ্ঠার প্রতি ধাবিত, উদ্দীপ্ত ও সতেজ। বিষাদের সহিত সম্পৃক্ত অবসাদ, নিস্তেজ আত্মমায়া-কণ্ডূয়নের স্থানই তাহার জীবনে নাই। সে হয়তো সুখ চাহে না, জয় চাহে। ভারত হয়তো তাহার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ লইয়া শঙ্কিত, কর্মসংস্থানের অভাব লইয়া চিন্তিত, সরকার তাহাকে যথেষ্ট সামাজিক নিরাপত্তা দিতেছে কি না তাহা লইয়াও জিজ্ঞাসু, কিন্তু ভারতের মধ্যে যদি ক্লীব উদ্যমহীনতার পরিবেশ না থাকে, বরং ‘কী হইয়া উঠিব’ ভাবিয়া দেশটি হইহই পদচারণা করিতে থাকে, তবে সে অসুখী এবং মহা প্রাণবন্ত এক দেশ।
পাকিস্তান যদি ভারতের অপেক্ষা সত্যই সুখী দেশ হয়, তাহা বিস্ময়কর। সম্ভবত সমীক্ষাভুক্ত পাকিস্তানিরা নিজ দেশের অবস্থা সম্পর্কে সম্যক অবহিত নহেন। আসলে, বহু ক্ষেত্রে সুখ উৎসারিত হয় অজ্ঞানতা হইতে। আগুন লাগিলেও দেখা যাইবে শিশু খলখল করিয়া সুখের হাসি হাসিতেছে। সেই বোধহীন সুখ সর্বনাশ ডাকিয়া আনে, উহা অপেক্ষা সচেতনতা-জাত অ-সুখ বহুগুণ কাম্য। যদি কেহ চার পাশে না তাকায়, জীবনের বহু সম্ভাবনা সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা না রাখে, তবে সে নিজ হতশ্রী অবস্থা লইয়া মহা সুখী হইতেই পারে। কিন্তু এই সুখ প্রগতিঘাতী। বস্তুত, অসুখী মানুষেরাই প্রগতির মূলে। মানুষ যদি মাটিতে হাঁটিয়াই সুখী থাকিত, কোনও দিনই বিমান বানানো হইত না। যদি কথা বলিয়াই তাহার সাধ মিটিত, কাব্য রচনার প্রয়োজনই পড়িত না। মানুষের সকল কীর্তির, মহান সার্থকতার মূলে এক তীব্র ও আশ্চর্য অসন্তুষ্টি, ‘নাল্পে সুখমস্তি’ প্রতিজ্ঞা। তাই ভারত তাহার প্রতিবেশীদের তুলনায় সম্ভবত অধিক দ্রুত অগ্রগামী, ইহাই এই তালিকা হইতে সংগ্রহযোগ্য নির্যাস।