সম্পাদকীয় ১

তেঁতুলপাতা নহে

সাধারণ ভাবেই ভারতে নিয়মভিত্তিক বা ‘রুল বেসড’ সমাজ আজও অপরিণত, অপূর্ণ। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ ক্রমশ একটি বেনিয়ম-ভিত্তিক সমাজে পরিণত হইতেছে। যাহা স্বাভাবিক নিয়ম, তাহা লঙ্ঘনের দাবি যদি একটি স্তর হয়, তবে সেই দাবি পূরণের জন্য অন্যায় অশোভন চাপ সৃষ্টির প্রবণতা তাহার অন্য স্তর।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০১৪ ০০:০০
Share:

সাধারণ ভাবেই ভারতে নিয়মভিত্তিক বা ‘রুল বেসড’ সমাজ আজও অপরিণত, অপূর্ণ। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ ক্রমশ একটি বেনিয়ম-ভিত্তিক সমাজে পরিণত হইতেছে। যাহা স্বাভাবিক নিয়ম, তাহা লঙ্ঘনের দাবি যদি একটি স্তর হয়, তবে সেই দাবি পূরণের জন্য অন্যায় অশোভন চাপ সৃষ্টির প্রবণতা তাহার অন্য স্তর। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে ছাত্র ভর্তিকে কেন্দ্র করিয়া এই বিশৃঙ্খলার পরম্পরাই আরও এক বার দেখা গিয়াছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরে উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীদের সকলে স্বাভাবিক নিয়মে সেখানে স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তি হইবার সুযোগ পান নাই, কারণ নিজস্ব পড়ুয়াদের জন্য স্নাতকোত্তর স্তরের ষাট শতাংশ আসন সংরক্ষিত থাকে, বাকি চল্লিশ শতাংশ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশার্থীদের জন্য। কিন্তু প্রেসিডেন্সির বিফলমনোরথ পড়ুয়ারা এই অপ্রাপ্তি মানিতে রাজি নহেন, অতএব তাঁহারা বিক্ষোভ শুরু করিয়াছেন, রাতভর ধর্না দিয়াছেন, আবারও দিবেন বলিয়া জানাইয়াছেন। এখনও তাঁহাদের বিক্ষোভ কোনও হিংস্র আকার ধারণ করে নাই, কিন্তু করিবে না যে, অভিজ্ঞতা তেমন কোনও নিশ্চয়তা দেয় না, বিশেষত দলীয় রাজনীতি যখন এই রাজ্যে ঘোলা জলে মাছ ধরিতে তত্‌পর।

Advertisement

প্রেসিডেন্সি কলেজের উপাচার্য বলিয়াছেন, ছাত্রছাত্রীদের দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল থাকিয়া তাঁহারা বিষয়টি বিবেচনা করিতে চাহেন। কথাটি তাঁহার বিবেচনাবোধের পরিচায়ক, সন্দেহ নাই। কিন্তু প্রশ্ন এ ক্ষেত্রে সহানুভূতির নয়, নিয়মের। স্নাতকোত্তর স্তরে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করিবার একটি নিয়ম আছে। সেই নিয়ম ঠিক কি ভুল, নিজস্ব পড়ুয়াদের জন্য ষাট শতাংশ আসনই সংরক্ষিত রাখা উচিত কি না, সেই সকল বিষয়ে তর্ক চলিতে পারে, ছাত্রছাত্রীরা সেই তর্কে যোগ দিতে পারেন এবং পরিচালকরা মনে করিলে পদ্ধতি বদলাইতে পারেন। কোনও নীতিই শাশ্বত নয়। কিন্তু ভর্তির প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটাইয়া সেই পরিবর্তন আনিবার চেষ্টা করা চলে না। অথচ ইহার আগেও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুরূপ দাবি উঠিয়াছে, বিক্ষোভ হইয়াছে, সেই বিক্ষোভ প্রায়শই সংযত থাকে নাই। যে কোনও নিয়মই চাপ দিয়া পালটানো যায় এই ধারণা বিপজ্জনক, কারণ তাহা সমাজের শৃঙ্খলাবোধকে ভিতর হইতে বিনাশ করে।

যে নিয়মটি এই সমস্যার মূলে, তাহার পর্যালোচনাও বিশেষ আবশ্যক। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর, দুইটি পাঠক্রম যদি ‘ইন্টিগ্রেটেড’ বা সংহত হয়, তাহা হইলে একটি স্তরে কৃতকার্য হইলেই পরবর্তী স্তরে উত্তরণ স্বাভাবিক। এ দেশেও এমন সংহত পাঠক্রম বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রচলিত আছে। কিন্তু প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ক্ষেত্রে সেই যুক্তি খাটে না। দুইটি স্বতন্ত্র পাঠক্রমকে স্বতন্ত্র হিসাবেই গণ্য করা উচিত। প্রেসিডেন্সির স্নাতক স্তরে উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীদের জন্য তাহার স্নাতকোত্তর স্তরে কেন এক শতাংশ আসনও সংরক্ষিত রাখা হইবে? অন্য কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক প্রবেশার্থীরা কেন সেখানে স্নাতকোত্তর স্তরে প্রবেশের সমান সুযোগ পাইবেন না? স্পষ্টতই, নিজস্ব ছাত্রছাত্রীদের জন্য ‘কোটা’ রাখিবার এই রীতি এক ধরনের স্বজনপোষণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালকদের এই স্পষ্ট কথাটি স্পষ্ট ভাবে উচ্চারণ করা ন্যায় প্রতিষ্ঠার তাগিদেই কর্তব্য। সেই কাজে সরকার তথা রাজনৈতিক দলগুলি যদি বাধা না দেয়, তাহাতেই সমাজের কল্যাণ। স্নাতকোত্তর স্তরে আসনসংখ্যা বাড়াইয়া দাবি পূরণের যে প্রস্তাবটি শোনা যাইতেছে, তাহা নিতান্ত কুপ্রস্তাব। আসনসংখ্যা নির্ভর করে পরিকাঠামো, শিক্ষকের সংখ্যা ইত্যাদির উপর, বিক্ষোভ মিটাইতে গিয়া দশ জনের স্থানে পনেরো জনকে ভর্তি করিলে পঠনপাঠনের ক্ষতি হইতে বাধ্য। ‘উত্‌কর্ষের কেন্দ্র’ কখনওই সেই ক্ষতি মানিতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় তেঁতুলপাতা নহে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন