কক্সবাজারের অস্তমিত সূর্যের গরিমা থাকতে পারে। এবং এ কথাও সত্য, প্রতিদিন নতুন নতুন রূপে দেখা যাবে তাবড় শিল্পীকে শাসন করা সেই দৃশ্যপট। অথবা, কর্ণফুলি নদী পেরিয়ে চট্টগ্রামে বাঙালির গর্বের বই-বিপণি তিন হাজার বর্গফুটের ‘বাতিঘর’-এর সুষমানিটোল পুস্তক আবহে স্তব্ধবাক হওয়াটাও আশ্চর্যের নয়। কুমিল্লার মনোহরপুরের রসমালাইয়ের এমনই মায়া, ক্রনিক ডায়াবিটিস রোগীও সেই দেব-ভোগের আস্বাদ গ্রহণে যাবতীয় ডাক্তারি অনুশাসন ভুলে তেড়েফুঁড়ে উঠবেন, এমন সত্য কথাও মানা যায়। নবমীর দুপুরে, চাটগাঁ-ফেণী-কুমিল্লা-ঢাকা রাজপথে সারি সারি গরু-ছাগলের হাটের পাশাপাশি কোনও নির্জন গ্রামের ‘সর্বজনীন দুর্গোত্সব’-এর শালু দেখে এপার বাংলার এক ছাপোষা মনিষ্যি হিসাবে অন্তর যে একেবারেই পুলকিত হয় না, তা-ই বলি কী করে! তার ওপর আমাদের ‘আনিসুজ্জামান স্যর’ যখন জানালেন, ‘এ বার বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে চারশো-পাঁচশো পুজো হয়েছে’, আমরা যে মুগ্ধ হইনি, এমনও নয়।
কিন্তু এই সব চমত্কারিত্বকে ছাপিয়ে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের শারদ উত্সব। আর আমরা জগন্নাথ হলের উপাসনালয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি সেই দশভুজাকে। গোপালগঞ্জের পঞ্চানন পালের তৈরি দুর্গাপ্রতিমার সামনে চিকনচাতালে যৌবনের ঝড়। ছেলেমেয়েরা ঢাকের তালে নেচে চলেছেন। এ তাল সংক্রামক। ততোধিক সংক্রামক এই আনন্দ-উচ্ছ্বাস। ছন্দহীন শরীরেও দোলা জাগায়! তালের সমতায় শুরু হয়েছে সিঁদুর খেলা। আজ এখন দশমী যে। সিঁদুরে রং লেগে গেছে ছাত্রছাত্রীদের গালে-কপালে। এবং আমাদেরও। ওদের মধ্যে যেতেই! বেপরোয়া ধুনুচি নাচ শুরু করেছেন ক’জন ছাত্র। অপূর্ব নাচ, অসামান্য ভারসাম্য বোধ! এ বোধহয় বাঙালির নিজস্ব শিল্পভাষা, বাঙালিরাই পারে। ধোঁয়ার আড়ালে দেখি এক উজ্জ্বল মুখ। রোগা-লম্বা, নরম দাড়ি। কুড়ি-বাইশ। কী নাম তোমার? জি, সুমন আরাফাত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। এবং মুসলমান। আশ্চর্য তো লাগবেই। সুমন হেসে জানালেন, ‘এখানে আমরা যারা নাচানাচি করছি, অনেকেই, বোধহয় অধিকাংশই মুসলমান।’ একটু থেমে, লাজুক হেসে জানালেন, ‘আমরা ঈদে কুরবানিও করি আবার দুর্গাপুজোয় আনন্দও করি।’ পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন আর এক ছাত্র। অজয় লোধ। একুশ। অ্যাকাউন্ট্যান্সির ছাত্র। চাঁদপুরে বাড়ি। অজয় ঘাড় নেড়ে সমর্থন করলেন সুমনকে, ‘এখানে ওই সব ভেদাভেদ নাই, আমরা সবাই ছাত্রছাত্রী, ব্যস্ ওইটাই শেষ কথা।’ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তনী সুমারানি দে-র গ্রামের বাড়ি যদিও মানিকগঞ্জ জেলায়, কিন্তু তেইশ-চব্বিশের এই কন্যার প্রথম পছন্দ জগন্নাথ হলের শারদ উত্সব। ‘আমি তো এখানেই এই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই থাকি, বাবা এখানকার কর্মচারী। আমরা জাতিধর্ম, বিভেদ ভুলে প্রতি বছর পুজোর আনন্দে মাতি। এই পুজো ছেড়ে অন্য কোথাও যাবার কথা ভাবতেও পারি না’, স্পষ্ট কথা সুমারানির।
বুড়িগঙ্গায় প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে ছাত্রছাত্রীরা ফিরে এলেন। ধরলাম দীর্ঘদিন এই পুজোর অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা অসীম সরকারকে। যিনি এখন জগন্নাথ হল-এর প্রোভোস্ট, সংস্কৃত বিভাগের চেয়ারম্যান, সেনেটের নির্বাচিত সদস্য। অসীমবাবু জানালেন, ‘১৯৭৮ থেকে এই পুজোর সূত্রপাত। কোনও দিনই এই শারদ উত্সবে জাতি-ধর্ম-বিভেদের ছায়া পড়েনি। তা পড়বেও না। আমাদের ছাত্রছাত্রীরা এই বিশ্বাস তাদের চেতনায় ধারণ করে।’ বুক ভরে গেল। কথায় কথায় রাত হয়ে গেছে। মাথার উপরে চাঁদ। পৃথিবীর সবেধন নীলমণি এই উপগ্রহটি আর দু’দিন পরেই ঈদের চাঁদ হয়ে উঠবে। সেই চাঁদ সাক্ষী রেখে জগন্নাথ হল ছেড়ে বেরোবার মুখে তিনতলা থেকে ভেসে আসে গিটার ঝংকার আর প্রমিত উচ্চারণ:
‘ঝিন্কা ঝিকা
ঝিন্কা ঝিকা...
মন আমার চড়ুই পাখি খেজুর গাছে বসিয়া...
ঝিন্কা ঝিকা...
ঝিকা ঝিকা...’