বা হবা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। শব্দদূষণকে বঙ্গজীবনে পুনরায় সগৌরবে অধিষ্ঠিত হইবার ছাড়পত্র দিবার কাজটি এমন নৈপুণ্য সহকারে আর কে করিতে পারিত? তাঁহাদের পরীক্ষায় চকোলেট বোমা, দোদমা, সকল বাজি এ বার পাশ করিয়াছে। শেষ অবধি কলকাতার মেয়রের হস্তক্ষেপে ওই সকল ভয়ানক বাজি নিষিদ্ধ হইয়াছে। কিন্তু রাজ্যবাসীর দৃষ্টিতে ফেল করিল পর্ষদ। পর্ষদ কর্তাদের যুক্তি, নমুনা বাজিগুলি ডেসিবেল সীমা পার করে নাই। বিনীত প্রশ্ন, পরীক্ষায় কি কেবল ডেসিবেল মাপিবার যন্ত্রই ব্যবহার হয়? নাকি পরীক্ষকের কাণ্ডজ্ঞানও কিঞ্চিৎ ব্যবহার হইবার কথা? নব্বই ডেসিবেল হইলেই ফেল, তাই ছিয়াশি ডেসিবেলের বাজি পাশ। কিন্তু দীপাবলির রাতে পাড়ায় কি একটিই চকোলেট বোমা ফাটিবে? একসঙ্গে দু’টি বাজি ফাটিলেই সহনসীমা লঙ্ঘিত হয়, তবে এই ছাড়পত্রের অর্থ কী? অসহনীয় শব্দ উৎপাদনই চকোলেট বোমা, দোদমার পরিচয়। যে পরিমাণ মশলা ভরিয়া, যে পুরুত্বের আস্তরণে মুড়িয়া নমুনা বাজিগুলিকে পেশ করা হইয়াছিল, পাইকারি হারে প্রস্তুত বাজি সেই ভাবেই প্রস্তুত হইবে, ইহা অবিশ্বাস্য। বিশেষত বাজি কুটির শিল্প, অপ্রশিক্ষিত কর্মীরা যাহা প্রস্তুত করিয়া থাকেন। অতএব নির্মাণের হেরফেরে শব্দসীমা ছাড়াইবে, ইহাই প্রত্যাশিত। বাজি পরীক্ষা করিতে গিয়া লোক হাসাইল পর্ষদ। ইহার চাইতে ঘণ্টা বাজাইয়া, ফুল ছুড়িয়া ‘ইহাগচ্ছ ইহ তিষ্ঠ’ বলিয়া তাঁহারা শব্দবাজিকে দোকানে অধিষ্ঠিত করিলে উপযুক্ত হইত।
পর্ষদ কর্তারা ভুলিয়াছেন, শব্দবাজি মাত্রই বর্জনীয়। তাঁহাদের দায়িত্ব শব্দের দৌরাত্ম্য হইতে রাজ্যবাসীকে নিষ্কৃতি দেওয়া। সুস্থ ও শান্তিময় জীবনের অধিকারকে সুরক্ষিত করাই পর্ষদের কাজ। উৎসব সকল দেশে হয়, কিন্তু তাহার সুযোগ লইয়া কতিপয় লোক অধিকাংশ নাগরিকের প্রাণ ওষ্ঠাগত করিবে, এমন উপদ্রব কোথাও নাই। দীপাবলি আলোর উৎসব। যে সকল আতসবাজি আলোর কারিকুরি দেখাইয়া আনন্দ দিয়া থাকে, সেগুলি বায়ুদূষণ না করিলে ছাড়পত্র পাইতে পারে। কিন্তু শব্দবাজি ছাড় পাইবে কেন? যে কোনও অপ্রয়োজনীয় শব্দ বর্জনীয়। ডেসিবেল মাপিবার প্রশ্ন উঠিবে কেবল প্রয়োজনীয় শব্দের ক্ষেত্রে। বিবিধ পরিবহণ, নানা প্রকার যন্ত্র প্রাত্যহিক জীবনে অপরিহার্য। সেগুলি হইতে উৎপন্ন শব্দের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। কিন্তু যে সকল শব্দ অনাবশ্যক, তাহা নিষিদ্ধ করাই কর্তব্য। বিশেষত শব্দবাজির ক্ষতি করিবার ক্ষমতা সুবিদিত। বাজির অত্যাচারে লোকে প্রাণ হারাইয়াছে, শ্রবণক্ষমতা হারাইয়াছে, আতঙ্কে পশুপাখি, শিশুরা দিশাহারা হইয়াছে, তাহার দৃষ্টান্ত কম নাই। বাজির উৎকট শব্দ জনজীবন অতিষ্ঠ করিয়াছে। আদালত এই সংকটের নিরসনের জন্যই বাজি নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দিয়াছিল। পর্ষদের কর্তারা ডেসিবেল মাপিয়া আক্ষরিক অর্থে বিধি পালন করিতেছেন, কিন্তু তাহার প্রকৃত উদ্দেশ্যের অবমাননা করিতেছেন। ইহাতে কতিপয় বাজি ব্যবসায়ীর লাভের পথ সুগম হইল। রাজ্যবাসীর ক্ষতি নিশ্চিত হইল।
তবে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের এই সিদ্ধান্ত অকস্মাৎ নহে। এ রাজ্যে উৎসবের উদ্যোক্তা-পালনকর্তাদের নিকট প্রশাসনের নতিস্বীকারের একটি ধারা পরিলক্ষিত হইতেছে। অতি-প্রলম্বিত ছুটি, অতি-আড়ম্বরে আয়োজন, অতি-উচ্ছ্বাসে উদযাপন, এগুলিই এ রাজ্যের বিশেষত্ব হইয়া উঠিয়াছে। স্বাভাবিক কর্মজীবন, নাগরিক জীবন ব্যাহত হইতেছে। গোটা রাজ্য একটি যেন ক্লাব, এবং পুলিশ-প্রশাসন তাহার ‘ভলান্টিয়ার’। উৎসবে উৎসাহ দেওয়াই যেন সরকারের কাজ। প্রশাসনিক কর্মসূিচ হইতে এই মনোভাব এ বার বিধিব্যবস্থায় প্রতিফলিত হইতেছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সিদ্ধান্তটি অশনি সঙ্কেত।