মনমোহন সিংহের সরকারের বিরুদ্ধে একটি বড় অভিযোগ ছিল, তাহারা কাজ করে না। ‘নীতিপঙ্গুতা’ শব্দটি সেই সরকারের কল্যাণে তৈয়ারি হইয়াছে বটে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নীতি রূপায়ণের পঙ্গুতা ছিল অনেক বেশি প্রবল এবং প্রকট। নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী সাফল্যের পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লইয়াছিল তাঁহার কর্মযোগী ভাবমূর্তি, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাঁহার কাজের খতিয়ান যে মূর্তিকে কেবল উজ্জ্বল করে নাই, বিশ্বাসযোগ্যতাও দিয়াছিল। ভোটদাতারা একটি নিষ্ক্রিয় সরকারের বদলে একটি সক্রিয় সরকার চাহিয়াছিলেন। সক্রিয়তার মস্ত গুণ ইহাই যে, তাহা চরিত্রে অতি স্বচ্ছ, তাহাকে সহজেই দেখা যায়, চেনা যায়। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদী কত নম্বর পাইবেন তাহা ভবিষ্যৎ বলিবে, একশো দিনে প্রধানমন্ত্রিত্বের পরীক্ষা হয় না, হইবার প্রয়োজনও নাই। কিন্তু সক্রিয়তার লক্ষণ ইতিমধ্যেই স্পষ্ট। ভারতীয় নাগরিকরা দেখিয়া আসিতেছেন, সরকারি কর্তাব্যক্তিরা যথোচিত আড়ম্বরে একটি মহৎ প্রকল্প ঘোষণা করেন এবং সচরাচর তৎক্ষণাৎ ভুলিয়া যান, যদি ভাগ্যক্রমে না ভোলেন, তবে সেই প্রকল্প রূপায়ণের কাজ চলিতে থাকে সরকারি ক্যালেন্ডার ধরিয়া, যে ক্যালেন্ডারে আঠারো মাসে বর্ষান্তর ঘটে।
নরেন্দ্র মোদী স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লার ভাষণে ঘোষণা করিয়াছিলেন, ভারতীয় ব্যাঙ্ক ব্যবস্থাকে তিনি সমস্ত নাগরিকের নিকট পৌঁছাইয়া দিতে চাহেন, সে জন্য ‘জন ধন যোজনা’ চালু হইবে, যাঁহাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নাই, তাঁহাদের অ্যাকাউন্ট খুলিয়া দেওয়া হইবে। ‘ফিনানশিয়াল ইনক্লুশন’ অর্থাৎ আর্থিক ব্যবস্থায় নাগরিকদের অন্তর্ভুক্তির ভিত্তি হিসাবেই এই প্রকল্পের ধারণা। সেই ঘোষণার পক্ষকালের মধ্যে তাঁহার সরকার যোজনার কাজ শুরু করিয়াছে। প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল এক বৎসরের মধ্যে, অর্থাৎ আগামী স্বাধীনতা দিবসের আগে সাড়ে সাত কোটি অ্যাকাউন্ট খোলা। এখন স্থির হইয়াছে, আগামী প্রজাতন্ত্র দিবসের মধ্যে, অর্থাৎ পাঁচ মাসেই লক্ষ্যে পৌঁছাইতে হইবে। এবং প্রথম দিনেই দেড় কোটি, অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার কুড়ি শতাংশ অ্যাকাউন্ট খোলা হইয়াছে। ইহা যদি সক্রিয়তা না হয়, সক্রিয়তা কাহাকে বলে?
সমস্ত নাগরিককে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার আওতায় আনা কি প্রয়োজনীয় ছিল? জন ধন যোজনা নামক প্রকল্পটি কি সফল হইবে? প্রথম প্রশ্নের উত্তর: অবশ্যই। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর: পরীক্ষা প্রার্থনীয়। ‘ফিনানশিয়াল ইনক্লুশন’ একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের পক্ষে জরুরি, সে কথা দুনিয়া জুড়িয়া স্বীকৃত। কিন্তু প্রকল্পটি যথাযথ ভাবে চালাইতে গেলে যে পরিকাঠামো এবং জনচেতনা জরুরি, তাহা আছে কি না, না থাকিলে তাহা গড়িয়া তোলা যাইবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর একমাত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়াই পাওয়া সম্ভব। সাধারণ মানুষ যাহাতে অ্যাকাউন্ট খুলিতে এবং চালু রাখিতে উৎসাহী হন, প্রকল্পের ভাবনায় তাহার জন্য একাধিক উৎসাহের আয়োজন রাখা হইয়াছে। পাঁচ হাজার টাকা ঋণ লইবার এবং ঋণ শোধ করিলে সমপরিমাণ নূতন ঋণের সুযোগ, অতি অল্প খরচে ডেবিট কার্ড এবং সচল অ্যাকাউন্টের সহিত দুর্ঘটনা ও জীবন বিমা— প্রত্যেকটি আয়োজনই উৎসাহবর্ধক। খাদ্য হইতে কেরোসিন, নানা ক্ষেত্রে প্রদত্ত সরকারি ভর্তুকি বা পেনশন ইত্যাদি বিভিন্ন খাতে প্রাপ্য অর্থ যদি এই অ্যাকাউন্টে জমা করিবার বন্দোবস্ত ক্রমশ চালু করা যায়, অ্যাকাউন্ট চালু থাকিবে। কিন্তু তাহা ‘আর্থিক অন্তর্ভুক্তি’র ভিত্তিমাত্র, প্রকৃত অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রয়োজন অর্থনীতির সামগ্রিক উন্নয়ন, যে উন্নয়নে সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক অংশীদার হইবেন। কেবল দ্রুত কাজ করিয়া সেই উদ্দেশ্য সাধন করা যায় না, তাহার জন্য প্রয়োজন যথাযথ উন্নয়ন-ভাবনা। সেই ভাবনা নরেন্দ্র মোদীর কতখানি আছে, ভবিষ্যৎ বলিবে।