পাতাল রেলের ভিড়-ঠাসা কামরায় নৈতিক তরুণতরুণী ঘনিষ্ঠ ভাবে দাঁড়াইয়া ছিলেন, এই অপরাধে স্বনিযুক্ত দুই অভিভাবক তাঁহাদের উদ্দেশে ক্রমান্বয়ে বিদ্রুপ, কটূক্তি, গালমন্দ তো করেনই, এমনকী মারধর করিতেও দ্বিধা করেন নাই। কামরাসুদ্ধ যাত্রীরা সমগ্র ঘটনাটি উপভোগ করিয়াছেন কি না জানা নাই, তবে তাঁহারা যে ওই জ্যাঠামহাশয়দের আচরণের যথেষ্ট প্রতিবাদ করেন নাই, ইহা জানা গিয়াছে। খাস কলিকাতা শহরের মধ্যবিত্ত মেট্রোপলিটন সংস্কৃতি ও মানসিকতা এখনও কী পরিমাণ সংকীর্ণ, মধ্যযুগীয়, শালীনতার মধ্য-ভিক্টোরীয় ধ্যান-ধারণায় আচ্ছন্ন, এই ঘটনা তাহারই প্রমাণ। কলিকাতা যে তত কিছু সভ্য মহানগর নয়, তাহার সভ্যতার আবরণ যে অতিশয় স্বচ্ছ ও ভঙ্গুর, তাহাতে সংশয় নাই।
মজার ব্যাপার হইল, যে দুই ‘অভিভাবক’ দুই যাত্রীর নিগ্রহ-লাঞ্ছনা করেন, তাঁহারা কোনও ব্যক্তিগত অপ্রাপ্তির দ্বারা তাড়িত হইয়া এমন আচরণ করেন নাই। অন্তত তেমন কথা মনে করিবার কোনও কারণ নাই। বরং তাঁহাদের আচরণ বলিয়া দেয়, তাঁহারা যথার্থই বিশ্বাস করেন যে এই ভাবে, প্রকাশ্য জনস্থানে যুবক-যুবতীদের ঘনিষ্ঠতা একটি সামাজিক অনাচার, একটি অশালীনতা, যাহা কোনও ক্রমেই বরদাস্ত করা যায় না, কেননা এ ধরনের আচরণ মানিয়া লইলে বা প্রকাশ্যে ঘটিতে দিলে সমাজে শৃঙ্খলা বলিয়া কিছু থাকিবে না, সমাজ উচ্ছন্নে যাইবে। থানায় যখন নিগৃহীতদের সহিত তাঁহাদেরও লইয়া যাওয়া হয়, তখন তাঁহারা সে কথাই বারংবার বলিতে থাকেন। সমাজের সুনীতি রক্ষার দায় স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে নিজেদের কাঁধে তুলিয়া লওয়ার জন্য তাঁহারা পুলিশের কাছে ধমক খাইয়াছেন। কিন্তু এই ধমকে মনোভাবের পরিবর্তন হইবে, এমন আশা করা বৃথা। বস্তুত, আপত্তি জ্ঞাপন ও সক্রিয় নিগ্রহ-লাঞ্ছনায় লিপ্ত হওয়ার ক্ষেত্রে হয়তো ওই দুই ব্যক্তিই অংশগ্রহণ করেন, কিন্তু কামরায় উপস্থিত অন্য যাত্রীরাও যে কমবেশি একই মনোভাবের শরিক, তাঁহাদের প্রতিবাদহীনতা কি তাহাই স্পষ্ট করিয়া দেয় নাই?
প্রেম-ভালবাসা, যৌনতা ইত্যাদি প্রশ্নে আজকের ভারতীয় সমাজ সনাতন ভারতের যথার্থ উত্তরসূরি নয়, বরং ঔপনিবেশিক যুগের ভিক্টোরীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার বোঝাই সে বহন করিয়া চলিয়াছে। খোলামেলা জীবনচর্যা যে এ দেশেরই ঐতিহ্য, সাহিত্য, শিল্পকলা, নাটক, নৃত্য, ভাস্কর্যে তাহার অফুরান নিদর্শন ছড়াইয়া থাকিলেও সমাজপতিরা সেগুলি হইতে কোনও শিক্ষা গ্রহণ করেন না। তাঁহারা নারীপুরুষের প্রকাশ্য আচরণে গ্রহণযোগ্যতার লক্ষ্মণরেখা টানিয়া দেন, সেই রেখা কেহ অতিক্রম করিলে নিজেরাই উল্লঙ্ঘনকারীকে শাস্তি বুঝাইয়া দিতে উদ্যত হন। এ ভাবেই পার্কে হাত-ধরাধরি করিয়া বসা প্রেমিক-প্রেমিকা তাঁহাদের রক্তচক্ষু কিংবা প্রহারের শিকার হন, বাসে-ট্রেনে মেলায়-মাঠে, পাড়ার গলির আনাচেকানাচে যুগলের লুকোচুরিতে তাঁহাদের ভ্রূ কুঞ্চিত হইয়া ওঠে। পাতাল রেলের কামরায় নীতি-পুলিশের ভূমিকায় দুই অভিভাবকের আচরণ তাহারই রকমফের। জুরাসিক যুগের এই ডায়নোসরদের যে করুণা করিবেন, এমন উপায়ও নাই। কেননা এমন ডায়নোসররাই এখনও সমাজের সর্বত্র তাহাদের কাঁটাওয়ালা লেজ আছড়াইয়া চলিয়াছে। আশার কথা কেবল এটুকুই যে, এক দিন প্রকৃতির নিয়মেই এই ডায়নোসররাও প্রজাতি হিসাবে বিলুপ্ত হইবে। সে বড় দীর্ঘ অপেক্ষা!