ইন্দোনেশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জোকো উইডোডো তাঁহার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী, প্রাক্তন স্বৈরাচারী জেনারেল সুহার্তোর জামাতা, প্রবোয়ো সুবিয়ান্তোকে পর্যুদস্ত করিলেও সুবিয়ান্তো আপন পরাজয় শিরোধার্য করেন নাই। নির্বাচনী কারচুপির অভিযোগ তুলিয়া তিনি পুনর্নির্বাচন দাবিও করিয়াছেন। তাঁহার দাবি বিবেচিত হইবে, কিন্তু তাহা আদায় হওয়ার সম্ভাবনা কম। সুবিয়ান্তো নিজেও অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল। রাজধানী জাকার্তার অভিজাত সমাজের প্রতিনিধি। তুলনায় উইডোডো নিতান্তই সাধারণ অবস্থা হইতে উঠিয়া আসিয়াছেন। ইন্দোনেশিয়ার ৭০ বছরের ইতিহাসে এমন কেহ প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হন নাই। অমলিন, স্বচ্ছ ভাবমূর্তি, জনদরদ এবং সংস্কারপ্রিয়তার জন্য এই রাজনীতিক দেশবাসীর মন জয় করিয়া লইয়াছেন। দ্বীপরাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ার সাড়ে পঁচিশ কোটি জনসংখ্যার সাড়ে উনিশ কোটিই বৈধ ভোটার, যাঁহাদের মধ্যে আবার ৭০ শতাংশই ৯ জুলাইয়ের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বুথে লাইন দিয়াছিলেন। একের পর এক সামরিক জেনারেল বা তাঁহাদের পুত্রকন্যাদের প্রেসিডেন্ট দেখিতে দেখিতে ক্লান্ত দেশবাসী ‘নিজেদের লোক’কে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া মারফত কর্ণধার বাছিয়া লইয়াছেন।
ইন্দোনেশিয়ার অর্থনীতি বিশ্বের দশম স্থানে। একদা তাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ফিলিপিন্সের মতো ‘এশীয় সম্ভাবনা’দের সহিত একাসনেই বসিত এই দেশ। কিন্তু দুর্নীতি, স্বজনপোষণ এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণ সেই অর্থনীতিতে স্থবিরতা আনিয়া দেয়। দেশবাসী এ জন্যই স্বচ্ছ ভাবমূর্তির সংস্কারক খুঁজিতেছিলেন। উইডোডোর উপর তাঁহারা আস্থা রাখিয়াছেন। জাকার্তার রাজনীতিতে বহিরাগত বলিয়াই তাঁহার কোনও নিজস্ব গোষ্ঠী নাই, কায়েমি স্বার্থচক্র নাই। তাঁহাকে যে সব দল সমর্থন করে নাই, বরং বিরোধিতা করিয়াছে, সেই সব দলেরও যোগ্য ও দক্ষতাসম্পন্ন প্রয়োগবিদদের তিনি নাকি মন্ত্রিসভায় স্থান দিতে আগ্রহী। এ জন্য ইতিমধ্যেই তাঁহার পছন্দের নামের তালিকা জনসাধারণের মতামত ও প্রতিক্রিয়ার জন্য অন্তর্জালে ছড়াইয়া দিয়াছেন। অর্থাৎ মন্ত্রিসভা গঠনেও তিনি জনাদেশ যাচাই করিতে ব্যগ্র। এই গণতান্ত্রিকতা সামরিক স্বৈরতন্ত্রে অভ্যস্ত ইন্দোনেশিয়ায় নূতন। জনসাধারণ তাই ইতিমধ্যেই তাঁহার অনুরাগী। তাঁহার সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ রাস্তাঘাট ও বন্দরের মতো পরিকাঠামোয় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, অবহেলিত পূর্বাঞ্চলের প্রদেশগুলির উন্নয়ন, মৎস্য উৎপাদন ও সামুদ্রিক সম্পদ বৃদ্ধি এবং আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতার উচ্ছেদ।
ভারতের সহিত ইন্দোনেশিয়ার কিছু মিল আছে। ভারতীয় গণতন্ত্রও একটি সচল, দুর্নীতিমুক্ত, গতিশীল সরকারের অন্বেষণ করিয়াছে। অর্থনৈতিক সংস্কারের রুদ্ধগতি মোচন করিয়া এখানেও নরেন্দ্র মোদীর সরকার ভর্তুকিমুক্ত অর্থনীতি ও প্রতিযোগিতার গুরুত্ব অনুধাবন করিয়াছেন। স্বজনপোষণ ঠেকাইতে এবং দুর্নীতি ঘুচাইতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেই প্রতিশ্রুতি তিনি কত দূর পূর্ণ করিতে পারেন বা করিতে চাহেন, তাহা অবশ্যই ভবিষ্যৎ বলিবে। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার প্রেক্ষাপটে ভারতীয় নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করিলে এই সত্যই নূতন করিয়া স্পষ্ট হইয়া উঠে যে, গণতন্ত্রের বহু ত্রুটি এবং অপূর্ণতা থাকিলেও তাহার অনুশীলনের মধ্য দিয়াই সাধারণ মানুষ প্রশাসনের সংস্কার চাহিতেছেন। এখানেই গণতান্ত্রিক কাঠামোর প্রকৃত ভরসা। আবার, এখানেই গণতান্ত্রিক শাসকদের গুরুদায়িত্বও।