সম্পাদকীয় ২

নিঃসঙ্গ প্রদোষ

বহু মানুষের ভিড়ে অপূর্ব একাকিত্বের কথা কাব্যে বর্ণিত হইয়াছে, কিন্তু বাস্তব দুনিয়ায় একাকিত্ব প্রায়শ ভয়ানক। বিশেষত বার্ধক্যের একাকিত্ব। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে, ভারতে দেড় কোটি ষাটোর্ধ্ব নাগরিক একা থাকেন। যে প্রবীণ দম্পতিরা কেবল দুই জনের সংসারে বাস করেন, তাঁহাদের হিসাবে যোগ করিলে সংখ্যাটি আরও অনেক বাড়িয়া যাইবে। তাঁহাদের নিঃসঙ্গতাও সচরাচর কাঙ্ক্ষিত নহে, তবে দুই জনের নিঃসঙ্গতা অপেক্ষা সম্পূর্ণ একাকিত্ব যে চরিত্রে স্বতন্ত্র, তাহা বলিবার অপেক্ষা রাখে না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০৫
Share:

বহু মানুষের ভিড়ে অপূর্ব একাকিত্বের কথা কাব্যে বর্ণিত হইয়াছে, কিন্তু বাস্তব দুনিয়ায় একাকিত্ব প্রায়শ ভয়ানক। বিশেষত বার্ধক্যের একাকিত্ব। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে, ভারতে দেড় কোটি ষাটোর্ধ্ব নাগরিক একা থাকেন। যে প্রবীণ দম্পতিরা কেবল দুই জনের সংসারে বাস করেন, তাঁহাদের হিসাবে যোগ করিলে সংখ্যাটি আরও অনেক বাড়িয়া যাইবে। তাঁহাদের নিঃসঙ্গতাও সচরাচর কাঙ্ক্ষিত নহে, তবে দুই জনের নিঃসঙ্গতা অপেক্ষা সম্পূর্ণ একাকিত্ব যে চরিত্রে স্বতন্ত্র, তাহা বলিবার অপেক্ষা রাখে না। অনুমান করা যায়, একক প্রবীণদের অধিকাংশই স্বেচ্ছায় এই নিঃসঙ্গ জীবন বাছিয়া লন নাই। ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনাচক্র এবং সমাজ ও অর্থনীতির গতি তাঁহাদের একা থাকিতে বাধ্য করিয়াছে। তাহার অন্য প্রমাণও জনগণনার পরিসংখ্যানে স্পষ্ট। দেশের প্রায় বারো আনা পরিবারে (হাউসহোল্ড) কোনও ষাটোর্ধ্ব সদস্য নাই, অর্থাৎ তাহারা ‘তরুণ’ পরিবার। পরিবারের বিভাজন এবং জীবিকা ও ‘স্বাধীন’ জীবনের সন্ধানে তরুণ সদস্যদের নিষ্ক্রমণ উত্তরোত্তর প্রবল হইতে প্রবলতর হইতেছে, এই পরিসংখ্যান তাহারই পরিণাম।

Advertisement

এই নিঃসঙ্গ বার্ধক্য পুরানো সমাজে বিরল ব্যতিক্রম হিসাবেই গণ্য হইত। সাধারণ ভাবে পরিবারের মানুষ সারা জীবন একই পরিবারে থাকিতেন, সেই পরিবার হইতেই বিদায় লইতেন। বার্ধক্য পরিবেষ্টিত থাকিত দ্বিতীয়, তৃতীয়, কখনও বা চতুর্থ প্রজন্মের উত্তরসূরিদের দ্বারা— একটি গাছের নীচে চার পাশে বীজ পড়িয়া যেমন পরবর্তী প্রজন্মের গাছ জন্ম লয় ও বাড়িতে থাকে। শিল্পবিপ্লব এই ‘প্রাকৃতিক’ জীবনধারায় ছেদ ঘটায়, বিশ্বায়ন সেই ছেদকে অভূতপূর্ব মাত্রায় পৌঁছাইয়া দেয়। পুরানো কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে গোষ্ঠী বা সমাজের যে গুরুত্ব ছিল, নূতন শিল্পনির্ভর অর্থনীতিতে তাহা ক্রমশ বিনষ্ট হইতে থাকে, ব্যক্তি হইয়া উঠে অর্থনীতির একক। সন্তানের সহিত অভিভাবকের সম্পর্কেও এই নূতন অর্থনীতির প্রভাব পড়িতেছে, সন্তান প্রতিপালনকে ক্রমশ দেখা হইতেছে মানবসম্পদে বিনিয়োগ হিসাবে। সেই মানবসম্পদ কর্মজীবনে অথবা কলেজজীবনে প্রবেশ করিবার পূর্বেই পরিবার ছাড়িয়া, বাসভূমি ছাড়িয়া অন্যত্র পাড়ি দিবে এবং বাকি জীবনে বৎসরে দুই এক বার ফিরিবে— ইহাই স্বাভাবিক জীবনধারা বলিয়া ধরিয়া লওয়া হইতেছে। ইহাই নূতন পৃথিবী। নিঃসঙ্গতার পৃথিবী। বার্ধক্যের নিঃসঙ্গতা তাহার অমোঘ অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

অর্থনীতি কেন বাধ্যতে। জীবিকা ও জীবনের বাস্তব কোনও বিচ্ছিন্নতার প্রতিকার খুঁজিবে না। পরিবার উত্তরোত্তর বিচ্ছিন্ন এবং বিচ্ছেদমুখী হইবে। নিঃসঙ্গতার উত্তর যদি খুঁজিতে হয়, তাহা খুঁজিতে হইবে পরিবারের বাহিরে, নূতন সমাজ সংগঠনের মধ্যে। সেই সমাজ পুরানো পারিবারিকতার ভিত্তিতে গঠিত হইবে না, তাহার মূলে থাকিবে বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত সংযোগ, যে সংযোগ কখনও পেশাভিত্তিক, কখনও বসবাসভিত্তিক, কখনও বা ব্যক্তিগত রুচি এবং পছন্দভিত্তিক। ইতিমধ্যেই তাহার নানা লক্ষণ দেখা যাইতেছে, গড়িয়া উঠিতেছে বিভিন্ন ধরনের নূতন ‘কমিউনিটি’। সোশ্যাল মিডিয়া অনেক ক্ষেত্রে তাহার উৎস বা অনুঘটক হইতেছে। চিরাচরিত বন্ধুত্বের ছকে এই সংযোগকে আঁটানো সম্ভব হইবে না। ইহা এক নূতন সমাজ। বার্ধক্য এই সমাজে নূতন সঙ্গী পাইবে, নূতন অর্থও। অবশ্যই ইহা প্রধানত নাগরিক সমাজের কথা। গ্রামসমাজে, বিশেষত দরিদ্র সমাজে নিঃসঙ্গ বার্ধক্যের দায় সম্পূর্ণ ভিন্ন গোত্রের। সেই প্রশ্ন স্বতন্ত্র ভাবে আলোচ্য।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন