মৃত্যুতেও অরুণা শানবাগের অধ্যায়টি সমাপ্ত হইল না। মৃত্যু তাঁহাকে দীর্ঘ তেতাল্লিশ বৎসরের যন্ত্রণা হইতে মুক্তি দিয়াছে। পাশাপাশি, ফিরাইয়া আনিয়াছে ইউথানাসিয়া বা নিষ্কৃতি মৃত্যুর বহু-আলোচিত প্রশ্নটিকে। যাঁহার জীবন অরুণার ন্যায় কোনও প্রত্যাবর্তন-সম্ভাবনাহীন প্রান্তে পৌঁছাইয়া যায়, যেখানে জীবনের আরও একটি দিনের অর্থ আরও চব্বিশ ঘণ্টার যন্ত্রণা, সেখানে কি প্রত্যক্ষ নিষ্কৃতি মৃত্যুই সেই রোগীর পক্ষে শ্রেষ্ঠ বিকল্প নহে? অস্বীকার করিবার উপায় নাই, তর্কের উভয় দিকেই যুক্তি যথেষ্ট। প্রশ্ন উঠিবেই, মানুষ যে প্রাণ সৃষ্টি করিতে পারে না, তাহাকে কাড়িয়া লইবার অধিকার তাহার আছে কি? অথবা, এক বার এই মৃত্যুকে আইনি স্বীকৃতি দিলে ভারতের ন্যায় দেশে তাহার অপব্যবহার রোধ করিবার উপায় কি? বিপ্রতীপ যুক্তি বলিবে, অপব্যবহার রোধ করিবার দায়িত্ব প্রশাসনের। সেই ব্যর্থতার দায় এক জন অসহায় মানুষের ঘাড়ে চাপাইয়া তাঁহার যন্ত্রণাকে দীর্ঘতর করিবার অধিকার রাষ্ট্রের নাই। অরুণার জীবদ্দশায় একাধিক বার এই তর্ক হইয়াছে। কোনও নির্ণায়ক সূত্রে পৌঁছানো সম্ভব হয় নাই। ভারতীয় গণতন্ত্রের পরিসরে তর্কটি আরও এক বার জাগিয়া উঠিলে তাহাকে যোগ্য মর্যাদা দেওয়াই বিধেয়।
তর্কটি কোনও নির্ণায়ক অবস্থানে পৌঁছায় নাই বটে, কিন্তু অরুণা শানবাগের নিষ্কৃতি মৃত্যু প্রার্থনা করিয়া দায়ের করা একটি মামলার রায়েই ভারতে পরোক্ষ নিষ্কৃতি মৃত্যুর স্বীকৃতি মিলিয়াছে। তবে, অতি বিরল ক্ষেত্রেই তাহা প্রযোজ্য। অরুণার ক্ষেত্রে আদালত জীবনদায়ী ব্যবস্থা প্রত্যাহার করিবার আদেশ দেয় নাই। কেন, সেই কারণটিতে এই তর্কের একটি জরুরি সূত্র নিহিত। যিনি মামলা করিয়াছিলেন, আদালত তাঁহাকে অরুণার ‘নিকটতম ব্যক্তি’ হিসাবে স্বীকার করে নাই। অর্থাৎ, কাহারও নিষ্কৃতি মৃত্যুর আবেদন গ্রাহ্য হইবে কি না, তাহা নির্ভর করিতেছে রোগীর সহিত আবেদনকারীর সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার উপর। প্রশ্নটি অতএব ‘এজেন্সি’র। যিনি নিজের জীবন-মৃত্যু বিষয়ে সিদ্ধান্ত করিবার মতো অবস্থায় নাই, তাঁহার হইয়া সিদ্ধান্ত করিবার অধিকারের। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠিবে, এই অধিকার কি কাহারও থাকিতে পারে? যতই নিকটাত্মীয় হউন, অন্য কাহারও প্রাণ হরণ করিবার সিদ্ধান্তের অধিকার তাঁহাকে দেওয়া চলে কি? প্রশ্নটি ঠিক-ভুলের মধ্যবর্তী ধূসর অঞ্চলে অবস্থিত। এই অধিকার কাহাকে দেওয়া চলে কি না, তাহা প্রথম প্রশ্ন। দ্বিতীয়ত, কোনও ব্যক্তির ক্ষেত্রে জীবন অপেক্ষা মৃত্যুই শ্রেয় কি না, সেই সিদ্ধান্তের অধিকারী হওয়ার জন্য শুধু রক্তের সম্পর্কই যথেষ্ট কি না, আর কী কী বিবেচনা করা বিধেয়, প্রশ্নগুলি উঠিবেই। গণপরিসরে উত্তর সন্ধান করিতে হইবে।
যে দেশগুলিতে নিষ্কৃতি মৃত্যু, অথবা ইচ্ছা মৃত্যুর অধিকার স্বীকৃত, সেখানকার আইনের বিশ্লেষণও বিধেয়। প্রত্যক্ষ নিষ্কৃতি মৃত্যু সব দেশেই বে-আইনি। কিন্তু, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, লুক্সেমবার্গের ন্যায় দেশে ইচ্ছা মৃত্যু বা চিকিৎসকের সাহায্যে আত্মহত্যার অধিকার স্বীকৃত। দেখিতে হইবে, যে নীতি অনুসরণ করিয়া এই স্বীকৃতি মিলিয়াছে, তাহা ভারতীয় গণতন্ত্রের নৈতিকতার কষ্টিপাথরে উত্তীর্ণ হইতে পারে কি না। কিন্তু, সম্পূর্ণ তর্কটি আবেগবর্জিত বিশ্লেষণী ভঙ্গিতে হওয়াই বিধেয়। প্রশ্নটি জটিল। তাহার সমাধানসূত্র খুঁজিবার কাজটিও যথোচিত গুরুত্ব দাবি করে। এই বিতর্কগুলিই গণতন্ত্রের পরিণতমনস্কতার পরীক্ষা। এই বার সেই পরীক্ষায় বসিবার সময় হইয়াছে।