প্রবন্ধ ২

প্রতিহিংসাই তবে আত্মরক্ষার উপায়

ইরাকের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, যারা সরকারের হয়ে জঙ্গিদের সঙ্গে লড়াইয়ে রাজি, তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার দায়িত্ব নেবে সরকার। ইরাক কি সত্যিই ভারত থেকে অনেক দূরে? শিলাদিত্য সেনক’দিন আগেই আগ্নেয়াস্ত্র-হাতে এক নিষ্পাপ বালকের ছবি দেখেছি একাধিক খবরের কাগজে। বালকটি ইরাকের, ক্রমাগত জঙ্গি হানা মোকাবিলার জন্যে তৈরি হচ্ছিল সে। ছবিটি দেখে, বা তার সংলগ্ন খবরটি পড়ে হয়তো আপনার অস্বস্তি হবে, ভাববেন: শেষ পর্যন্ত শিশুকেও হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হচ্ছে! কিন্তু ইরাক-প্রশাসন এমনটাই চাইছে, কারণ তাদের দেশের একের পর এক অঞ্চল জঙ্গিদের দখলে চলে যাচ্ছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৪ ০০:০১
Share:

দেশরক্ষার দায়। রাষ্ট্রের আহ্বানে সেনাবাহিনীতে নাম লেখাতে স্বেচ্ছাসেবকদের ভিড়। বাগদাদ, ২৪ জুন। ছবি: এপি।

ক’দিন আগেই আগ্নেয়াস্ত্র-হাতে এক নিষ্পাপ বালকের ছবি দেখেছি একাধিক খবরের কাগজে। বালকটি ইরাকের, ক্রমাগত জঙ্গি হানা মোকাবিলার জন্যে তৈরি হচ্ছিল সে। ছবিটি দেখে, বা তার সংলগ্ন খবরটি পড়ে হয়তো আপনার অস্বস্তি হবে, ভাববেন: শেষ পর্যন্ত শিশুকেও হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হচ্ছে! কিন্তু ইরাক-প্রশাসন এমনটাই চাইছে, কারণ তাদের দেশের একের পর এক অঞ্চল জঙ্গিদের দখলে চলে যাচ্ছে।

Advertisement

ইতিমধ্যেই ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নুরি আল-মালিকি ঘোষণা করেছেন যে, যারা সরকারের হয়ে জঙ্গিদের সঙ্গে লড়াইয়ে রাজি, তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার দায়িত্ব নেবে সরকার। প্রধানমন্ত্রী আর তাঁর শিয়া-প্রধান সরকারই শুধু নয়, শিয়া ধর্মগুরু আয়াতোল্লাহ্ আলি আল-সিস্তানি তাঁর সম্প্রদায়ের মানুষকে একই আহ্বান জানিয়েছেন। ধর্মগুরুর মতে, দেশকে রক্ষা করার জন্যে অস্ত্রধারণই এখন সাধারণ মানুষের জাতীয় কর্তব্য। ইরাকি প্রশাসন-সরকার-প্রধানমন্ত্রী-ধর্মগুরুর ডাকে দলে দলে অস্ত্র-হাতে লড়াইয়ে শামিল হচ্ছে শিয়া জনসাধারণ, শিশুদের সঙ্গে মেয়েরাও।

প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজের ছবিতে ইরাকের সাধারণ মানুষজন এ ভাবে সশস্ত্র হয়ে উঠতে দেখে আপনার-আমার অস্বস্তি হয়তো বেড়েই চলেছে। কিন্তু মুশকিল হল, ও দিকে যে সুন্নি-অধ্যুষিত জেহাদি জঙ্গিহানাও বেড়ে চলেছে। ইরাকের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সেনা-পুলিশ সকলকেই নির্বিচারে হত্যা করছে জঙ্গিরা, আর ইরাকি সেনাবাহিনী জঙ্গিদের এই হত্যালীলার সঙ্গে কিছুতেই এঁটে উঠতে পারছে না, তাদের লাগাতার হামলার সামনে প্রায় পর্যুদস্ত। এমতাবস্থায় ইরাকি শিয়া-সাধারণের একটা বড় অংশ মনে করছে যে তাদের নিজ হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়াটা ঠিক সিদ্ধান্ত, তীব্র জঙ্গিহানা রুখবার এ ছাড়া আর উপায় কী!

Advertisement

এর প্রায় প্রতিধ্বনিই যেন শুনতে পেলাম অক্ষয়কুমারের গলায়। বলিউডের এই জনপ্রিয় নায়ক সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘যদি জঙ্গিরা কার্যসিদ্ধির জন্য তাদের জীবন দিয়ে দিতে পারে, তা হলে সাধারণ নাগরিকেরাই বা দেশকে বাঁচানোর জন্য তাঁদের জীবন দেবেন না কেন? দেশরক্ষার দায় কি কেবল সেনাবাহিনীর?’ বলিউডের সাম্প্রতিক ছবি ‘হলিডে: আ সোলজার ইজ নেভার অফ ডিউটি’তে জঙ্গিদমনকারী সেনা-অফিসারের চরিত্রে অভিনয়ের সুবাদেই তাঁর এই প্রশ্ন। ছবিতেও তিনি তাঁর বন্ধু বা বোনকে কথাচ্ছলে প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়েছেন, ‘সেনাবাহিনীর এক জন বলে কেবল আমিই জীবন পণ রেখে জঙ্গিদের সঙ্গে লড়ব, আর তোমরা শুধু জীবন উপভোগ করবে? কেন? সদাসতর্ক থাকবে না কেন? জঙ্গিরা যেমন আত্মাহুতি দেয়, তোমরাই বা তা করবে না কেন?’ ছবির বাইরে সাক্ষাৎকারে অবশ্য অক্ষয় আরও সিরিয়াস: ‘সন্ত্রাস নিয়ে তিন বছর রিসার্চ করে ছবি বানিয়েছেন পরিচালক, এতে অভিনয় করে আমি গর্বিত। এটা আমার হাসি-মজা-মসালা ছবি নয়, অত্যন্ত সিরিয়াস ও সৎ ছবি, যেখানে দেখানো হয়েছে এক জন সেনা-অফিসার হিসেবে আমি কী ভাবে জঙ্গিদের শায়েস্তা করছি।’

সত্যিই, আমাদের দেশে বিভিন্ন শহরে, বিভিন্ন সময়ে জঙ্গি হানায় প্রমাণ হয়ে গেছে যে, আমরা নাগরিক হিসেবে মোটেও নিরাপদ নই। এই সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ যাদের, যে ধরনের যোদ্ধাদের চিন্তাপ্রসূত, তাদের মোকাবিলায় অনেক সময়ই আমাদের গোয়েন্দা দফতর-প্রসাশন-পুলিশ-সেনাবাহিনী যে কতখানি ব্যর্থ, তা হাতেনাতে প্রমাণ হয়ে গেছে। অতএব, অক্ষয় তাঁর ছবির সূত্রে আমাদের নাগরিকদের যে সদাসতর্ক হতে বলছেন, সরকার-নির্ভরতা ছেড়ে প্রয়োজনে জঙ্গিনিধন যজ্ঞে মেতে উঠতে বা আত্মাহুতি দিতে বলছেন, তা অবান্তর বলে গণ্য করা কঠিন।

কিন্তু আপনি যদি পাল্টা প্রশ্ন তোলেন, সতর্ক না-হয় থাকা গেল, আত্মাহুতি দিতে যাব কেন? কোনও সদুত্তর দিতে পারব না। যে গণতান্ত্রিক কাঠামোয় আমাদের স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, তাতে তো আইন-আদালত-প্রশাসন-পুলিশ-সেনাবাহিনী রয়েছে, তাদের হাতেই তো দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ভার, জনসাধারণ খামখা আত্মাহুতি দিতে যাবে কেন? তা ছাড়া, সাধারণ মানুষের রাজস্বেই তো রাজ্যপাট চলে, প্রতিরক্ষা খাতে প্রতি বছর অনেক টাকা বরাদ্দ করা হয়। তার পরে আবার জনে জনে দেশের জন্য শহিদ হতে হবে?

আসলে আপনার-আমার সামরিক সহযোগিতার কোনও প্রয়োজন রাষ্ট্রের নেই, প্রয়োজনটা নৈতিক স্বীকৃতি অর্জনের। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যে-যুদ্ধ অবিরত চালিয়ে যেতে হচ্ছে ভারত সরকারকে, তার নীতিগত আবশ্যিকতা প্রমাণের জন্য সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় নাগরিকদের নৈতিক দায়িত্বের কথা তুলে ধরাটা বিশেষ জরুরি হয়ে উঠেছে। আর এ ব্যাপারে সরকারের খুব বড় সহায়ক বলিউড। বলিউডের ফিল্মই পারে তার বিপুল এবং বিস্তৃত বাজার মারফত সরকারের এই কর্মসূচিকে একটা মানবিকতার মোড়ক দিতে। দেশ ও জাতির জন্য সাধারণ নাগরিকদের এ ভাবে সৈন্য করে তোলার ভিতর দিয়ে আদতে ‘সিটিজেন আর্মি’র ধারণাটাই আরও পাকাপোক্ত হচ্ছে আস্তে আস্তে। আপনি তো জানেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী নিজেই অনেক সময় নাগরিকদের উজ্জীবিত করার জন্যে পরোক্ষ প্রশ্রয়ে তাদের হাতে আইন-বহির্ভূত অতিরিক্ত ক্ষমতা আরোপ করে, যাতে জঙ্গিনিধনে তৎপর হওয়ায় তাদের আর কোনও বাধা না থাকে। ‘সালওয়া জুড়ুম’ ভুলে যাননি তো আপনি। ‘হলিডে’ ছবিতে অক্ষয়কুমার জঙ্গিদের একে-একে খুন করে চলেন, পুলিশ-প্রশাসন-মিডিয়া-জনসাধারণ, কাউকে কিচ্ছুটি না জানিয়ে।

এর শুরু সম্ভবত ‘শোলে’ থেকে, ১৯৭৫-এর ১৫ অগস্ট মুক্তি পেয়েছিল ছবিটি। তারিখের সঙ্গে সঙ্গে সালটাও খেয়াল করবেন। তার কিছু দিন আগেই ভারত জুড়ে জারি হয়েছিল জরুরি অবস্থা। গণতন্ত্র বিপন্ন বলে প্রশাসনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল বিশেষ কিছু ‘ক্ষমতা’, যাতে তারা দেশদ্রোহী বা সমাজবিরোধীদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে দেশকে। ‘শোলে’র আসল নায়ক কিন্তু সঞ্জীবকুমার। এই পুলিশ অফিসার তাঁর গ্রামবাসীকে আমজাদ খানের অত্যাচার থেকে রক্ষা করার জন্যে আইনের রাস্তায় না হেঁটে, হিংসা দিয়েই হিংসা রুখবার জন্যে জেল থেকে দুই আসামি অমিতাভ বচ্চন আর ধর্মেন্দ্রকে ছাড়িয়ে আনেন। শেষে তিনি নিজে যখন গব্বরকে আক্রমণ করেন, তখন তাঁর প্রতিহিংসার চেহারাটা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।

বিশেষ ‘ক্ষমতা’র বশবর্তী হয়ে কোনও পুলিশ অফিসার একা উড়িয়ে দিচ্ছে দেশদ্রোহীদের ‘শোলে’র পর থেকে প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এমন একগুচ্ছ ছবি তৈরি হয়েছে বলিউডে। কিন্তু এক জন সাধারণ নাগরিক এই হিংসাত্মক ক্ষমতার প্রয়োগ করছে, এমন ছবি ততটা তৈরি হচ্ছে না বলিউডে, ব্যতিক্রম ‘আ ওয়েনেসডে!’ ২০০৮-এ তৈরি এই ছবিতে নাসিরুদ্দিন শাহ এক জন সাধারণ নাগরিক, নিজের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নেন জঙ্গিনিধনের। সদাসতর্ক, আত্মাহুতিতে প্রস্তুত এই মানুষটি নিজেকে ‘কমনম্যান’ বলে চিহ্নিত করেন এবং মুম্বইয়ে বোমা বিস্ফোরণে হত্যা করেন সন্ত্রাসবাদীদের। পুলিশ কমিশনারকে ফোনে সাবধান করে দেন, ‘আমি শুধু আপনাকে মনে করাতে চাই যে, সাধারণ মানুষ কিন্তু অসম্ভব রেগে গেছে, আপনারা তাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নেওয়া বন্ধ করুন। বিপর্যয় সত্ত্বেও আমরা উঠে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছি... আমি নিশ্চিত যে, ট্রেনে বিস্ফোরণ ঘটানো মোটেও কোনও সরল সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ নয়, এর মধ্যে দিয়ে ওরা আমাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে, সেটা এ রকম: আমরা এ ভাবেই তোমাদের মেরে যাব, আর তোমরা কিস্যু করতে পারবে না!’ এই উচ্চারণ থেকে এক জন নাগরিকের মনে প্রতিহিংসা জন্মানোর কারণটা টের পাওয়া যায়। রাষ্ট্র নিজেই যদি সেই প্রতিহিংসাকে ব্যবহার করতে তৎপর হয়, তার পরিণাম?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন