সম্পাদকীয় ১

প্রশ্ন নৈতিক অধিকারের

সমাজকে একটি গ্রহণযোগ্য, এবং অতি অবশ্যই বাসযোগ্য, আকারে ধরিয়া রাখিতে আইনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু, সমাজবদ্ধ মানুষের নিকট কোন আচরণটি সর্বাপেক্ষা কাম্য, শুধু আইনের মাপকাঠি তাহা নির্ধারণ করিতে পারে না। আইন একটি কাঠামো। অতি জরুরি কাঠামো, নিঃসন্দেহে, কিন্তু সেই কাঠামোয় প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে নৈতিকতা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share:

সমাজকে একটি গ্রহণযোগ্য, এবং অতি অবশ্যই বাসযোগ্য, আকারে ধরিয়া রাখিতে আইনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু, সমাজবদ্ধ মানুষের নিকট কোন আচরণটি সর্বাপেক্ষা কাম্য, শুধু আইনের মাপকাঠি তাহা নির্ধারণ করিতে পারে না। আইন একটি কাঠামো। অতি জরুরি কাঠামো, নিঃসন্দেহে, কিন্তু সেই কাঠামোয় প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে নৈতিকতা। কথাটি অনেকেই স্মরণে রাখিতে পারেন না। অথবা, এই কথাটি স্মরণে থাকিলে তাঁহাদের স্বার্থে ঘা পড়িবে, এমন আশঙ্কায় স্বেচ্ছায় ভুলিয়া থাকেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী যেমন। কলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের গণভোটের ফল বলিতেছে, ৯৭ শতাংশই তাঁহাকে নিজেদের উপাচার্য রূপে দেখিতে চাহেন না। অভিজিৎবাবু এই গণভোটের ফলকে গুরুত্ব দিতে নারাজ, কারণ ইহার ‘আইনি স্বীকৃতি’ নাই। রাজ্যপালও একই কারণে এই প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করিতে অস্বীকার করিয়াছেন। এই গণভোটের ফলাফলকে স্বীকৃতি দিতেই হইবে, এমন কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবিধানে নাই। অতএব, অভিজিৎ চক্রবর্তী উপাচার্যের কুর্সি আঁকড়াইয়া থাকিয়া আইনত কোনও অন্যায় করিতেছেন না। কিন্তু, অনুমান করা চলে, এই ক্ষেত্রে ‘আইন’ তাঁহার নিকট একটি রক্ষাকবচ মাত্র— নৈতিকতার বৃহত্তর দাবি যাহাতে তাঁহার সত্তাকে গ্রাস না করিতে পারে, তাহা নিশ্চিত করিতেই তিনি আইনকে অজুহাত রূপে ব্যবহার করিতেছেন।

Advertisement

বৃহত্তর নৈতিকতার দাবি বলিবে, শিক্ষকের সহিত ছাত্রদের সম্পর্ক শুধু আইনি সূত্রে বাঁধা থাকিতে পারে না। ছাত্রছাত্রীরা যদি কাহাকে শিক্ষাক্ষেত্রে নিজেদের সর্বোচ্চ অভিভাবক রূপে দেখিতে অস্বীকার করেন, তবে সেই পদটি আঁকড়াইয়া থাকা সেই শিক্ষকের পক্ষে অনৈতিক। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মধ্যে যে পারস্পরিক বিশ্বাস, শ্রদ্ধা-স্নেহের সম্পর্ক, আইনের সাধ্য কী তাহার পরিসীমা নির্দিষ্ট করিয়া দেয়! অভিজিৎ চক্রবর্তী নিতান্ত নিজের দোষেই সেই সম্পর্কটি বিনষ্ট করিয়াছেন। আইন তাঁহাকে এখনও প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপদে বসাইয়া রাখিতে পারে। কালীঘাটের আশীর্বাদও তাঁহার সঙ্গেই আছে। কিন্তু, তাঁহার প্রতি ছাত্রদের বিশ্বাস বা শ্রদ্ধা ফিরাইয়া দিতে পারে, আইন বা আশীর্বাদের সেই ক্ষমতা নাই। বিশেষত, এই গণভোটের ফল বলিতেছে, উপাচার্য তাঁহার বিরুদ্ধে ছাত্রদের ক্ষোভ আঁচ করিতে ভুল করিয়াছিলেন। তিনি বলিয়াছিলেন, মাত্র কুড়ি শতাংশ ছাত্র অশান্তি সৃষ্টি করিতেছে, বাকিরা তাঁহার সঙ্গেই আছে। গণভোটের ফল সম্ভবত তাঁহার ভ্রম ঘুচাইয়াছে। ছাত্রদের এই প্রত্যাখ্যান শিরোধার্য করিয়া তিনি পদত্যাগ করিলে তাঁহার সম্মান বাঁচিত, শিক্ষককুলেরও।

সম্ভবত তেমনটি হইবে না। আইনের রক্ষাকবচ ব্যবহার করিয়া যত দূর যাওয়া সম্ভব, উপাচার্য যাইবেন; তাঁহার রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকরাও যাইবেন। বস্তুত, আইনের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখিলে ‘উপাচার্যের প্রাণহানির আশঙ্কায়’ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাতদুপুরে পুলিশ ডাকা বে-আইনি নহে, কমান্ডো আসিয়া কমান্ডো-উচিত আচরণ করিবে তাহাও আইনসিদ্ধ। আইনসিদ্ধ ছাত্র ও বৃহত্তর সমাজের যাবতীয় ক্ষোভ অস্বীকার করিয়া উপাচার্য পদে অভিজিৎ চক্রবর্তীর নাম প্রস্তাব করা এবং সেই প্রস্তাব অনুমোদনও। গণভোটের রায় অস্বীকার করা তো আইনি বটেই। কিন্তু, ইহার কোনওটিই নৈতিক নহে। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক নৈতিকতার যে তারে বাঁধিবার কথা, এই ঘটনাগুলির প্রত্যেকটিই তাহার বিপ্রতীপ। অভিজিৎ চক্রবর্তী অনৈতিক, সুতরাং লজ্জাকর দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছেন। তাঁহার আচরণ শিক্ষকসুলভ নহে। তিনি নির্মম শাসকের ভূমিকা লইয়াছিলেন। আইন তাঁহাকে এই শাসকের আসনে অবিচল রাখিতে পারে। অভিভাবক হইবার নৈতিক অধিকার তাঁহার আর নাই।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন