সম্পাদকীয় ২

পথের দাবি

ফরাসিতে ‘দেজা ভু’ কথাটির অর্থ, বিস্মৃতের স্মরণ। ফুটপাথের খাবার লইয়া নবতম প্রকল্পটির সংবাদ তেমনই ভাব জাগায়। ডেনমার্কের একটি সংস্থার সহায়তায় এই প্রকল্প পাঁচ বৎসর ধরিয়া বৃহত্তর কলকাতার সহস্রাধিক পথখাদ্য-বিক্রেতাকে পরিচ্ছন্নতা শিখাইয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share:

ফরাসিতে ‘দেজা ভু’ কথাটির অর্থ, বিস্মৃতের স্মরণ। ফুটপাথের খাবার লইয়া নবতম প্রকল্পটির সংবাদ তেমনই ভাব জাগায়। ডেনমার্কের একটি সংস্থার সহায়তায় এই প্রকল্প পাঁচ বৎসর ধরিয়া বৃহত্তর কলকাতার সহস্রাধিক পথখাদ্য-বিক্রেতাকে পরিচ্ছন্নতা শিখাইয়াছে। উদ্দেশ্য মহৎ। কিন্তু এ কাজ কি আগেও হয় নাই? নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় আন্তর্জাতিক খাদ্য সংস্থার সহায়তায় কলকাতার ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ’ এ বিষয়ে একটি বিশদ সমীক্ষা করিয়াছিল। বিক্রেতাদের পরিচ্ছন্নতার পাঠও দিয়াছিল। স্বাস্থ্য দফতর ও কলকাতার পুলিশ কমিশনার স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যের স্বার্থে বিক্রেতাদের বৈধতা দিবার বিষয়ে নানা প্রস্তাব রাখিয়াছিলেন। কী ধরনের প্রযুক্তিগত সহায়তা পাইলে বিক্রেতারা খাবারের মান উত্তম রাখিতে পারিবেন, তাহারও আলোচনা হইয়াছিল। তাহার পর সে সকল প্রস্তাব-পরামর্শ সকলে ভুলিয়াছে। ফের চাকা উদ্ভাবন করিবার পালা শুরু হইয়াছে। বিদেশি স্বেচ্ছাসেবীদের আগ্রহ ফুরাইলে এই পর্বও হয়তো বিস্মৃতিতে সরিয়া যাইবে। হয়তো পাঁচ-দশ বছর পর ফের কলকাতায় পথখাদ্যের পরিচ্ছন্নতা লইয়া সমীক্ষা চলিবে। পুরাতন পরামর্শের নূতন তালিকা প্রস্তুত হইবে।

Advertisement

অথচ বিষয়টি গুরুতর। দুই দশক পূর্বের সমীক্ষায় পথখাদ্যের ঝুঁকির যে চিত্রটি সম্মুখে আসিয়াছিল, তাহা নগণ্য নহে। মহাকরণ, শিয়ালদহ, কলেজ স্কোয়্যার ও গড়িয়াহাটের নানা দোকান হইতে নমুনা পরীক্ষা করা হয়। তাহার ফল বলিয়াছিল, বিরিয়ানি ও নানাবিধ মিষ্টান্নে ব্যবহৃত রঙের একটি বড় অংশ ধাতব রং, যাহা খাদ্যে ব্যবহারের যোগ্য নহে। দই, ঘোল ও অন্যান্য পানীয়তে স্যালমোনেলা এবং ই-কোলাই জীবাণুর উপস্থিতি ছিল উদ্বেগজনক। সে দিনও স্পষ্ট হইয়াছিল যে যথাযথ উপায় জল ও খাবার সংরক্ষণ করা, এবং তাহার ব্যবহার-পরিবেশনে অপরিচ্ছন্নতা, এগুলিই সংক্রমণের প্রধান কারণ। দু’দশক আগে যে পরিচ্ছন্নতার পাঠ দেওয়া হইয়াছিল, আজ ফের সেই সকল পাঠই দেওয়া হইতেছে।

কিন্তু পাঠদানই কি যথেষ্ট? পরিচ্ছন্নতার উপায় জানা নাই বলিয়াই কি বিক্রেতারা তাহা পালন করেন না? সাম্প্রতিক প্রকল্পটিতেও দেখা গিয়াছে, পাঠ গ্রহণের পরেও বহু বিক্রেতা তাহা পালন করেন না। বাড়তি পরিশ্রম করিয়া কী লাভ, এই প্রশ্ন তাঁহাদের মনে ওঠা স্বাভাবিক। তাঁহারা ব্যবসা করিতে আসিয়াছেন, জনসেবা নহে। ফলে প্রশ্নটি অসঙ্গত নহে। ইহার দুটি উত্তর হইতে পারে। এক, পরিচ্ছন্নতা বাড়িলে খদ্দের বাড়িবে। অ্যাপ্রন-পরিহিত বিক্রেতা থার্মোকলের নূতন থালায় খাবার দিলে তাহা সুস্বাস্থ্যের আশ্বাস আনে, অতএব আরও বেশি খদ্দের তাহাতে আগ্রহী হইবেন, এই সম্ভাবনা বিক্রেতাকে অনুপ্রেরিত করিতে পারে। কিন্তু এই যুক্তি যথেষ্ট নহে। কারণ এই দৃষ্টিতে খাবারের বৈচিত্র, দাম, স্বাদ প্রভৃতির সহিত পরিচ্ছন্নতা আরও একটি বিচার্য। বিক্রেতার নিকট তাহা ‘আবশ্যক’ বলিয়া মনে না হওয়াই স্বাভাবিক। অধিক লাভের যুক্তি দিয়া পরিচ্ছন্নতাকে নিশ্চিত করা সম্ভব নহে। তাহার একমাত্র উপায় নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ। সেই কাজ পুরসভাগুলির। কিন্তু কলকাতা কিংবা জেলা শহর, সর্বত্র পুর কর্তৃপক্ষ উদাসীন। জনগণের উদ্দেশে কিছু সতর্কবার্তা প্রচার করিয়াই তাঁহারা কাজ সারেন। পুরাতন প্রচার নিয়া নূতন করিয়া কোমর বাঁধিতে হয়। এই প্রহসন বন্ধ হউক।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন