সম্পাদকীয় ১

ফৌজ-ই-গণতন্ত্র

পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ধীর কিন্তু নিশ্চিত গতিতে, কিছুটা অন্তরালে থাকিয়া দেশের রাজনীতি ও প্রশাসনের উপর হৃত প্রাধান্য ফিরাইয়া আনিতেছে। উপলক্ষ: ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ এবং মৌলবি তাহির-উল-কাদরির অনুগামীদের অবরোধ আন্দোলন। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ইস্তফার দাবিতে আন্দোলনকারীরা পাক স্বাধীনতা-দিবসে ইসলামাবাদ অবধি পদযাত্রা করিয়া রাজধানী অবরুদ্ধ করেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share:

পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ধীর কিন্তু নিশ্চিত গতিতে, কিছুটা অন্তরালে থাকিয়া দেশের রাজনীতি ও প্রশাসনের উপর হৃত প্রাধান্য ফিরাইয়া আনিতেছে। উপলক্ষ: ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ এবং মৌলবি তাহির-উল-কাদরির অনুগামীদের অবরোধ আন্দোলন। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ইস্তফার দাবিতে আন্দোলনকারীরা পাক স্বাধীনতা-দিবসে ইসলামাবাদ অবধি পদযাত্রা করিয়া রাজধানী অবরুদ্ধ করেন। অবরোধ ক্রমে পাকিস্তানের পার্লামেন্ট ভবন, এমনকী প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন পর্যন্ত প্রসারিত হয়। প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের মোকাবিলায় আগেই সেনা ডাকিয়াছিলেন, বাহিনীর প্রহরাতেই রাজধানীর দিনরাত্রি কাটিতেছে। আন্দোলনের নেতারা সেনাবাহিনীকে যুযুধান দুই পক্ষের মধ্যস্থতা করার আর্জি জানাইলে বাহিনী তাহা সানন্দে গ্রহণ করে। যেন পাক সেনাবাহিনী দেশের বিরোধী পক্ষের রাজনীতিক বনাম নির্বাচিত সরকারের মধ্যে এক নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রীও সেই মধ্যস্থতার ভূমিকা শিরোধার্য করিতে একপ্রকার বাধ্য হইয়াছেন।

Advertisement

অথচ পাক পার্লামেন্টে নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগের নিরাপদ গরিষ্ঠতা ছিল। ক্ষমতাসীন হইয়া ভারত ও আফগানিস্তান সম্পর্কে প্রচলিত পাক বিদেশ নীতিতে পরিবর্তন আনার ইঙ্গিতও নওয়াজ দিতেছিলেন। ভারতের সহিত অনাক্রমণ ও মৈত্রীর চুক্তি এবং আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক না-গলাইবার নীতির দিকে ক্রমশ অগ্রসরমান নওয়াজ স্বভাবতই সেনাবাহিনীর বিরাগভাজন হইয়া পড়েন। কেননা এই দুইটি ক্ষেত্রে দেশের বিদেশ নীতি এত কাল সেনাবাহিনীর শীর্ষ জেনারেলরাই নিয়ন্ত্রণ করিয়াছেন। দেশের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সহিত সখ্য স্থাপিত হইলে সেনাবাহিনীর রণসজ্জা হ্রাস করার, সেই খাতে জাতীয় আয়ের বিপুল অংশ অপব্যয়ের প্রশ্নটিও সামনে চলিয়া আসিবে। অতএব গোড়াতেই সেই অস্বস্তিকর সম্ভাবনা নির্মূল করা শ্রেয়। জেনারেল রাহিল শরিফ তাই নিরপেক্ষতার মুখোশ পরিয়া সরকার ও সরকার-বিরোধীদের মধ্যে মধ্যস্থতার ময়দানে অবতীর্ণ। পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইহা এক সম্পূর্ণ নূতন সমীকরণ। লক্ষণীয়, সংসদীয় বিরোধী পক্ষ পিপল্স পার্টির নেতা আসিফ আলি জারদারি প্রধানমন্ত্রীর সহিত সাক্ষাত্‌ করিয়া তাঁহার সরকারের স্থিতিশীলতা সমর্থন করিয়াছেন। তত্‌সত্ত্বেও যখন সেনাপ্রধান ইমরান খান ও তাহির-উল-কাদরির রাজধানী অবরোধের আন্দোলনকে বৈধতা দিতে আগাইয়া আসেন, তখন সেনাবাহিনীর অভিপ্রায় সম্পর্কে সংশয় থাকে না।

পরিষদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও এবং পাকিস্তানের ইতিহাসে এই প্রথম একটি গণতান্ত্রিক সরকারের বিদায়ে অপর একটি গণতান্ত্রিক সরকারের অভিষেক মসৃণ ভাবে সংঘটিত হইলেও নওয়াজ শরিফ তাহার ফসল কুড়াইতে অক্ষম। মৌলিক নীতির রদবদলে তাঁহার নিজের দ্বিধা এবং বিলম্বও প্রতিপক্ষকে সুযোগ দিয়াছে। পাকিস্তানে সেনাবাহিনী বরাবরই রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করিয়াছে। অধিকাংশ সময় অত্যন্ত স্থূল ভাবে, সরাসরি সামরিক অভ্যুত্থান মারফত ক্ষমতাদখল করিয়া। এ বার অনেক সূক্ষ্মভাবে একটি নির্বাচিত সরকারের শাসন পরিচালনার বৈধতা ক্ষুণ্ণ করা হইতেছে। সেনাধ্যক্ষ রাহিল শরিফ প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ওই পদে মনোনীত হইলেও তাঁহার আনুগত্য মনোনয়নকারীর প্রতি নয়। বরং জেনারেল পারভেজ মুশারফকে রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে কাঠগড়ায় তোলার জন্য তিনি নওয়াজের প্রতি ক্ষুব্ধই ছিলেন। প্রথমত, ব্যক্তিগত ভাবে তিনি মুশারফের ভাবশিষ্য, দ্বিতীয়ত জেনারেলের দেশদ্রোহে অভিযুক্ত হওয়া তাঁহার কাছে অশনি সংকেত। তাই ইসলামাবাদের প্রশাসনিক অচলাবস্থার সুযোগ লইয়া তিনি মধ্যস্থতাকারী রূপে আসরে অবতীর্ণ। লক্ষণ শুভ নয়।

Advertisement

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন