প্রায় ২৭ বছর পর এ বার দুর্গাপুজোর সময় পশ্চিমবঙ্গে এলাম। ভারতের শাহি দরবার যে আসলে শুধুমাত্র দিল্লি নামক রাজধানীতেই নিবদ্ধ নয়, এটি যে আসলে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের দৈনন্দিন হাল-হকিকতের সঙ্গে যুক্ত সেটা যত দিন যাচ্ছে ততই বেশি বেশি করে বুঝতে পারছি।
দুর্গোৎসবের সময় গোটা কলকাতা শহর জুড়ে আলোর রোশনাই। দিল্লিতে দিওয়ালির সময় হয় বটে কিন্তু সেটা মূলত ঝুলন্ত টুনি-বাল্বের মালাতেই সীমাবদ্ধ। দিল্লিতে দিওয়ালিতে একটা ভয়ঙ্কর বৈভব প্রদর্শন হয় সেটা হল বাজি ফাটানো। এত বছর ধরে সেটা দেখছি আর ফি বছর মনে হয় কালো টাকা পুড়ছে। কলকাতা এবং শহরতলিতে কিন্তু যতটা না টুনি-বাল্বের জনপ্রিয়তা তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হল আলোর খেলা। কোথাও জুরাসিক পার্কের ডাইনোসর নাচছে, কোথাও একটি মেয়ে বাঘের পিঠে চেপে স্কিপিং করছে, হতদরিদ্র মফস্বলের অলিগলিতেও সারা রাত ধরে এই আলোর রোশনাই। কলকাতায় এখন বিদ্যুৎ সঙ্কট নেই। লোডশেডিং হয় না। কিন্তু বাঙালি মনের মধ্যে কোথাও একটা অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। আমি সমাজমনস্তাত্ত্বিক নই। কিন্তু বারংবার মনে হচ্ছিল, বাঙালি তার মননের আঁধার থেকে হয়তো বেরোতে চাইছে, আর তাই এত আলোর আয়োজন।
লম্বা হওয়া বা বিরাট হওয়াটাও তাই বোধহয় বাঙালির কাছে খুব প্রয়োজনীয় জিনিস। আর সেই জন্য দেশপ্রিয় পার্কের মা দুর্গার বৈশিষ্ট্য ছিল গিনেস বুকে যাওয়ার উচ্চতা। আর সেই সুদীর্ঘ মা দুর্গাকে দেখার জন্য এমন ভিড় হল যে মানুষ আহত হল এবং শেষে বন্ধ করে দেওয়া হল সেই পুজোই। মধ্যমগ্রাম থেকে দক্ষিণেশ্বর যাওয়ার পথে একটি বাড়ির ছাদে দেখলাম এক বিশাল গডজিলার মূর্তি। কলকাতা মিউজিয়ামে রাখা ডাইনোসরের কঙ্কাল ক’জন দেখেছেন তা জানি না, তবে ডাইনোসর এখন বাঙালির প্রিয় পশু। বাঙালি কি চাইছে ডাইনোসরের মতো একটা বিরাটত্ব? তবে এই বিরাট হওয়ার বাসনাটা কেবল বাঙালির একার নয়, সর্দার পটেলের মূর্তি স্থাপনা থেকে শুরু করে জাপানে আইফেল টাওয়ারের অনুকরণে টোকিও টাওয়ার তৈরি করা এ সব কি ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স! একই কারণে কি তৈরি হয় কলকাতার লেকটাউনে বিগ বেনের ঘড়ি?
তবে শুধু বিরাটত্ব নয়, দুর্গাপুজোর সময়ে বাঙালির মনন এবং মুড, এই দু’টোই নানা দিক থেকে বোঝার চেষ্টা করছি। উত্তর ২৪ পরগনার দমদম থেকে বিরাটি, বরাহনগর, অশোকনগর, হাবড়া, এক দিকে এ সব এলাকা আর অন্য দিকে ডায়মন্ড হারবার, শহরতলির ব্যারাকপুর, নৈহাটি, হাওড়ার মন্দিরতলা, হুগলির কোন্নগর— সব জায়গাতেই মাইকে কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজতে শুনলাম। কলকাতা শহরে জানি না, কিন্তু জেলাগুলিতে এখনও ব্যান্ডের গানের চেয়ে রবীন্দ্রনাথের গানের দাপট বেশি। আরতি-সন্ধ্যা-শ্যামলের পুরনো আধুনিক গান চলছে হইহই করে। হঠাৎ হঠাৎ কানে আসছে মান্না দে’র ‘ললিতা ওকে আজ চলে যেতে বল না’। রবীন্দ্রনাথের গানে ভেবেছিলাম এখন নতুন শিল্পীদের বেশি দাপট হবে। অন্তত দিল্লির বাঙালির রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা দেখে অন্তত তাই মনে হয়, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের জেলার মণ্ডপগুলিতে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় আর দেবব্রত বিশ্বাসই বেশি শোনা যাচ্ছে। ২৫-২৬ বছরে জেলাগুলি অনেক বদলে গিয়েছে। প্রমোটার থেকে সিন্ডিকেট, চাইনিজ থেকে বিরিয়ানি। কলকাতা শহরে শুধু নয়, শহরতলিতে ও জেলাগুলিতে ব্যাপক ভাবে বাঙালি বিরিয়ানি খাচ্ছে। কার্যত চাউমিনের জায়গা নিয়ে নিয়েছে বিরিয়ানি (এর সমাজমনস্তাত্ত্বিক কারণও আমি জানি না)।
কিন্তু বাঙালি কি সত্যি ভাল আছে? ট্র্যাফিক সিগন্যালে রবীন্দ্রনাথের গান শুনছি, সিটি সেন্টারে বা সাউথ সিটি মলে কিশোর-কিশোরী হাত ধরে সেলফি তুলছে, ঠাকুরদা নতুন ধুতি পরে হাতে লাঠি নিয়ে বাড়ির দুর্গোপুজোয় একটি চেয়ারে বসে সপ্তমীর পুজো দেখছেন— এ সব আনন্দের দিক। কিন্তু বাঙালি কি ভাল আছে?। গাড়িতে বসে এফএম চ্যানেলে শুনলাম, অ্যাঙ্কর একটি মেয়েকে প্রশ্ন করছে, ‘পুজোয় কী করবে?’ মেয়েটি বলল, ‘পুজো হপিং।’ অ্যাঙ্করের প্রশ্ন, ‘বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে?’ উত্তর এল: ‘হ্যাঁ।’ আবার প্রশ্ন, তাঁর নাম কি? মেয়েটি বলল, বয়ফ্রেন্ডের নাম এফএম চ্যানেলে বলে দেব, সেটা একটু চাপ হয়ে যাবে না! অ্যাঙ্করের জবাব, ‘ওকে। ওকে। চাপ নিতে হবে না। চাপ নিও না।’
বাঙালি চাপ নিতে চায় না। দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়ে বাঙালি পুজোর সময় ছবি দেখছে রাজকাহিনী। তার কাছে সেটা একটি বেশি লম্বা বাংলা সিরিয়ালের মতো। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর বুঝতে পারছি এ রাজ্যের আর্থ-সামাজিক অবস্থা খুব খারাপ। প্রায় প্রতিটি পরিচিত পরিবারে এক জন করে বেকার। এক শিক্ষিত কমার্স গ্র্যাজুয়েট হাওড়ার মন্দিরতলায় ভুজঙ্গের ধারে দাঁড়িয়ে বলল, চাকরি পাইনি। তাই টোটো চালাচ্ছি। ছেলেটি তৃণমূল করে। টোটো চালকদের একটি ইউনিয়ন রয়েছে। সেটিও তৃণমূলের। এই চাইনিজ প্রযুক্তি এখন জেলাগুলিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। হাওড়ার ট্রাম ডিপোতে নেমেই একটি ছোট্ট মনিহারি দোকান। দোকানের মালিক জানালেন, দাদু এই দোকান তৈরি করেছেন। তিন প্রজন্মের দোকান। লাভ যথেষ্ট ভাল। কিন্তু ভদ্রলোকের ছেলে আর দোকানের ব্যবসা করবে না। সে এখন স্নাতক হয়ে টাটা কোম্পানিতে কেরানির চাকরি পেয়েছে। এটা বাঙালির এক সমস্যা। দোকানদার বাবার রোজগার অনেক বেশি। কিন্তু ছেলে সেই ব্যবসা করবে না। কিন্তু গুজরাতি বা দিল্লির গুপ্ত বা গোয়েল পরিবারের ছেলে হলে ভাবতেন, তাঁর শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে কী ভাবে এই দোকানকে আরও সম্প্রসারিত করা হয়। কলকাতায় কোনও শাখা করা যায় কি না। কিন্তু মেকলের তৈরি করা বাঙালি কেরানি এবং তাঁর সঙ্গে মিলে সিপিএমের কেরানি-কমিউনিজম-এই চক্রবূহ্যের শিকার বাঙালি। তৃণমূল জমানাতেও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। এই রাজ্যে স্টার্ট আপ মানে সিন্ডিকেট অথবা তোলাবাজি।
এ সবের মধ্যেও বাঙালির সহজ মানবিতকার ছোঁয়াও কিন্তু বারংবার স্পর্শ করা যায়। এক আত্মীয় হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন। নিমেষে কেউ বরফ নিয়ে এল, কলেজের দুই ছাত্রী আইসক্রিম খাচ্ছিল, সে সব ভুলে রুমালে পুরে সেই বরফ ঘষতে লাগলো, এক অচেনা কিশোর এসে চটি পরিয়ে দিল। দিল্লিতে এ দৃশ্য বহু দিন দেখিনি। লাজপত নগরে পথ দুর্ঘটনায় মুমূর্ষু রোগীকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেও কেউ গাড়ি থামাচ্ছে না। আর গাড়ি থামাতে গিয়ে দেখি পিছনে এক লম্বা গাড়ির মিছিল তুমুল ভাবে হর্ন দিয়ে আমায় এগোতে বলছে। কোনও কোনও পাঠক হয়তো বলবেন, দিল্লি অনেক ব্যস্ত। সেখানে অনেক কাজ। কলকাতায় অত কাজ নেই। তাই অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ছন্নছাড়া যুবকেরা আজও সমাজসেবা করে। জানি না, সমাজতাত্ত্বিকদের কাছ থেকে এই হিং টিং ছট প্রশ্নের জবাব চাইব। আপাতত শিকড়ের সন্ধানে ২৭ বছর পর এই দুর্গোৎসবে যে বাঙালিকে দেখলাম তাদের কথা জানালাম আপনাদের। শাহি দিল্লি থেকে এই মানুষজন কী সহস্রবর্ষ দূরে!