সম্পাদকীয় ১

বিপন্নতার পুনর্বাসন

পু নর্বাসন কথাটির অর্থটি ঠিক কী? ভাবাইয়া তুলিল কাশ্মীর। পুনর্বাসন মানে কি যে সব পরিবারের একটি স্থানে বসবাস ছিল তাহাদের সেই স্থানে ফিরাইয়া দেওয়া? নাকি কিছু আনতাবড়ি নির্বাচিত পরিবারকে ওই স্থানে নূতন বন্দোবস্তে থাকিতে দেওয়া? এমনকী তাহাদের সেখানে থাকিতে রীতিমত বাধ্য করা?

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০১
Share:

পু নর্বাসন কথাটির অর্থটি ঠিক কী? ভাবাইয়া তুলিল কাশ্মীর। পুনর্বাসন মানে কি যে সব পরিবারের একটি স্থানে বসবাস ছিল তাহাদের সেই স্থানে ফিরাইয়া দেওয়া? নাকি কিছু আনতাবড়ি নির্বাচিত পরিবারকে ওই স্থানে নূতন বন্দোবস্তে থাকিতে দেওয়া? এমনকী তাহাদের সেখানে থাকিতে রীতিমত বাধ্য করা? কাশ্মীর উপত্যকা হইতে যে হিন্দু পণ্ডিতরা পঁচিশ বৎসরেরও আগে বাড়িঘর ছাড়িয়া নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে পলাইয়া আসিয়াছিলেন, তাঁহাদের সেই ঐতিহাসিক উচ্ছেদ স্মরণ করিয়া আজ যদি কাশ্মীরে হিন্দু পণ্ডিতদের জন্য আলাদা, দেওয়াল-ঘেরা বাসস্থান বন্দোবস্ত হয়, যাহাতে সেই দেওয়ালের বাহিরে তাঁহাদের আসিতে না হয়, সে জন্য স্কুল হাসপাতাল সবই সেই দেওয়ালের মধ্যে গুঁজিয়া দেওয়া হয়, এবং অনেক পণ্ডিতই যদি এ ভাবে আবার কাশ্মীরে প্রত্যাবর্তনের সুযোগে নিতান্ত অনিচ্ছুক বোধ করেন, এই গোটা প্রক্রিয়াটিকে কি ‘পুনর্বাসন’ বলা চলে? কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ প্রশ্নটি লইয়া যথেষ্ট ভাবিয়াছেন বলিয়া মনে হয় না। ভাবিলে যে ভাবে তাঁহারা কাশ্মীরে হিন্দু পণ্ডিতদের একটি আবদ্ধ বাসভূমি তৈরি করিয়া তাঁহাদের সেখানে যেন তেন প্রকারেণ ঢুকাইয়া দিয়া নিজেদের হিন্দুত্বপ্রেমিতার বিজ্ঞাপন দিতেন না। পুনর্বাসন ঠিক এই ভাবে হয় না। তাহার জন্য আরও পরিকল্পনা লাগে, আলাপ-আলোচনা লাগে, অন্যান্য বিরুদ্ধভাবাপন্ন পক্ষের সহিত এক টেবিলে বসিয়া আলোচনা কিংবা দর-কষাকষি চালাইতে হয়। সে সব ছাড়াই ‘পুনর্বাসন’ কার্যক্রম এক বেলায় সারিয়া দিবার মধ্যে রাজনীতি থাকিত পারে, কিন্তু সামাজিক সুচিন্তা বা সুবুদ্ধি নাই।

Advertisement

স্বভাবতই মুখ্যমন্ত্রী মুফতি মহম্মদ সইদ প্রীত নন। বিজেপি-র তৎপরতায় এই পণ্ডিত পুনর্বাসন প্রকল্প তাঁহাকেই সর্বাপেক্ষা বিপদে ফেলিয়াছে। এমনিতেই কাশ্মীরের মধ্যে ‘ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন’ তৈরি হইতে দেখিলে কাশ্মীরি মুসলিম কিংবা হিন্দু পণ্ডিত কাহারও ভাল লাগিবার কথা নয়। রাজ্যবাসীর আশঙ্কার বিস্তর কারণ আছে যে, বলপূর্বক পুনর্বাসনের সরকারি প্রকল্প শেষ হইয়া গেলেই বিরাট় নৈরাজ্য ও হিংসা দেখা দিতে পারে। কাহারও পক্ষেই আমৃত্যু দেওয়াল-অন্তরীন জীবন কাটানো অসম্ভব, সুতরাং দেওয়ালের বাইরের অমিত্রসুলভ সমাজের মুখোমুখি হইতে হইবে। সেখানে প্রশাসন থাকিবে না, রাজনীতি থাকিবে না, থাকিবে কেবল এক বিপন্ন বৈপরীত্য, যাহার সামাজিক মীমাংসা ব্যতিরেকেই রাজনৈতিক পদক্ষেপ হিসাবে পুনর্বাসন প্রকল্প গৃহীত হইয়াছে।

রাজনাথ সিংহদের বক্তব্য, পুনর্বাসন লইয়া এত বাগবিতণ্ডার দরকার কী, ইহা তো বিজেপি-পিডিপি সমঝোতারই অংশ। যুক্তিটি সত্য নয়। বিষয়টি লইয়া আলোচনার মাধ্যমে অগ্রসর হওয়া, আর একতরফা ভাবে একটি নীতি ঘোষণা করিবার মধ্যে অনেকখানি ফারাক। ফারাক আরও বা়ড়ে, যখন এক পক্ষের পিছনে অত্যন্ত তীব্র সংশয়বাদী, এমনকী রাষ্ট্রবিরোধী শক্তির চাপ থাকে। ঠিক তাহাই ঘটিতেছে মুফতির ক্ষেত্রে। বিজেপি-র সহিত তিনি যখন হাত মিলাইয়া সরকার গড়িতে আসেন, তখন ঠিক এই কারণেই কট্টর ইসলামিরা তাঁহার বিরোধিতা করিয়াছিল। শেষ পর্যন্ত বিরোধিতার বাধা কাটাইয়া বিজেপি-পিডিপি শরিক সরকার তৈরি হইয়াছে। এই সাফল্যের শর্তটুকু মাথায় রাখিয়াই বিজেপির আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে অন্য পদ্ধতিতে এগোনো উচিত ছিল। কেন্দ্রীয় ক্ষমতার স্পর্ধায় যদি জম্মু ও কাশ্মীরের বিশিষ্ট রাজনৈতিক পরিবেশটি বিজেপি মাথায় না রাখে, তবে রাজ্যের সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রেরও বিপুল সংকট উপস্থিত হইতে পারে। হাজার হউক, স্থানটি কাশ্মীর। আন্তর্জাতিক মানচিত্রে যাহা ভারত-বহির্ভূত অঞ্চল বলিয়া ইতিমধ্যেই চিহ্নিত।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন