সম্পাদকীয় ১

বিভিন্নতার দাবি

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উদ্দেশে সম্প্রতি বলিয়াছেন: তাঁহার সরকার ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার সকল চেষ্টা করিবে। এই বাক্যের পিছনে কতখানি বিশ্বাস কিংবা আশ্বাস আছে, বলা মুশকিল। কিন্তু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিকট তাঁহার বার্তা যদি তিনি সত্যই পৌঁছাইতে চান, তবে এই বাক্যটিই সর্বাধিক জরুরি হইবার কথা। মানসিক দূরত্ব কিংবা সামাজিক হিংসা কমাইবার প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘমেয়াদি, অনেক জটিলও বটে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:২২
Share:

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উদ্দেশে সম্প্রতি বলিয়াছেন: তাঁহার সরকার ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষার সকল চেষ্টা করিবে। এই বাক্যের পিছনে কতখানি বিশ্বাস কিংবা আশ্বাস আছে, বলা মুশকিল। কিন্তু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিকট তাঁহার বার্তা যদি তিনি সত্যই পৌঁছাইতে চান, তবে এই বাক্যটিই সর্বাধিক জরুরি হইবার কথা। মানসিক দূরত্ব কিংবা সামাজিক হিংসা কমাইবার প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘমেয়াদি, অনেক জটিলও বটে। কিন্তু সরকার যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠার ঐকান্তিক চেষ্টা করে, পর পর পাঁচ-পাঁচটি খ্রিস্টান প্রতিষ্ঠানে হামলা হইলেও নিস্পৃহ থাকিবার ভুলটি আর না করিতে চায়, সে ক্ষেত্রে কেবল প্রশাসনিক সমদর্শিতার উপর নির্ভর করিয়াই সংখ্যালঘুরা আর একটু স্বস্তি বোধ করিতে পারেন। ভারতীয় গণতন্ত্রও আর একটু অর্থপূর্ণতার দিকে অগ্রসর হইতে পারে। বাস্তবিক, দেশের বিশাল সংখ্যক সংখ্যালঘু মানুষের যে ক্ষোভ এবং অসহায়তা, তাহার অন্যতম প্রধান কারণ কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির অকর্মণ্যতা। প্রতিষ্ঠানগুলি ঠিকঠাক কাজ করিলেই এই বিপুল জনসমাজ অনেকখানি নিরাপত্তা ও স্বস্তি বোধ করিতে পারিত। অর্থাত্‌ সামাজিক স্থিতি ও নিরাপত্তা বোধ ফিরাইয়া আনিবার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির যথার্থ কার্যকারিতাই যথেষ্ট। প্রধানমন্ত্রী যদি সেটুকু নিশ্চিত করিতে পারেন, তবেই দেশের সংখ্যালঘু সমস্যার অনেকখানি সমাধান সম্ভব।

Advertisement

নরেন্দ্র মোদীর সরকার এক অর্থে এই প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াসের শুরুটি করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে। সংখ্যালঘু সমাজের একটি দেশব্যাপী সমীক্ষার আয়োজন হইতেছে। কোনও সদর্থক পদক্ষেপ করিতে গেলে এমন কোনও সমীক্ষা ব্যতীত বাস্তব পরিস্থিতিটি বোঝা দুষ্কর। আরও লক্ষণীয়, ভারতীয় শিখ, খ্রিস্টান, জৈন, পারসিক ও বৌদ্ধ সমাজের এমন সমীক্ষা ইতিপূর্বে হয়নি। বৃহত্তম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হইবার কারণে একমাত্র ভারতীয় মুসলমান সমাজ বিষয়ে একটি সার্বিক সমীক্ষা হইয়াছে, ইউপিএ আমলে রাজেন্দ্র সাচার কমিটির মাধ্যমে। সাচার কমিটির সমীক্ষাটি ইতিমধ্যে এক অনন্য মহিমা অর্জন করিয়াছে, এবং সম্ভবত সেই কারণেই এই বারের মোদী সরকারের সংখ্যালঘু সমীক্ষা প্রকল্প হইতে দেশের মুসলিমরা বাদও পড়িয়াছেন।

মুসলিমদের বাদ দিবার সিদ্ধান্তটি প্রশ্নাতীত নয়। সংখ্যালঘু দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী নাজমা হেপতুল্লা বলিয়াছেন, ভিন্ন ভিন্ন সমাজের অবস্থানের মধ্যে নিজস্বতা ও বিশিষ্টতা এতই বেশি যে আলাদা ভাবে তাহাদের পর্যালোচনা না করিলে অর্থযুক্ত পরিবর্তন ঘটাইবার আশা মরীচিকা। কেবল ধর্মভেদে নহে, প্রদেশ-ভেদেও বৈচিত্রের ছবিটি পাল্টাইয়া যায়। কথাটি নূতন নয়। সমাজতত্ত্ববিদরা বহু বার খেয়াল করাইয়াছেন যে, ‘সংখ্যালঘু’ কোনও একশৈলিক অস্তিত্ব নয়: ইতিহাসের গতির বিচিত্রতা ও সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণে বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরিস্থিতি, দাবিদাওয়া বিভিন্ন রকমের। গত ডিসেম্বরে সুপ্রিম কোর্টে জৈন সম্প্রদায়ের এক প্রতিনিধি গোষ্ঠীও বৈষম্যমূলক সামাজিক আচরণের বিরুদ্ধে লড়িতে গিয়া সংখ্যালঘুর মধ্যেকার এই বৈচিত্রের বিষয়টির উপর জোর দিয়াছে। প্রশ্ন এখানেই। এই যুক্তিতে মুসলিম সমাজকেও সমীক্ষায় রাখা উচিত ছিল। প্রথমত, যদি প্রত্যেক সমাজের একটি বিশিষ্ট অবস্থান থাকেই, তবে সেই বিশিষ্টতার খাতিরেই দেশের গরিষ্ঠ সংখ্যালঘু সমাজের সম্পর্কে তথ্য জানা দরকার। সংখ্যালঘু-বিরোধিতার চরিত্রটিও যে সমাজভেদে বিভিন্ন, তাহাও তো মুসলিমদের দৃষ্টান্তেই বোঝা যায়, এবং সেই জন্য সংস্কারের প্রয়োজনটিও তীব্রতর ভাবে অনুভূত হয়। দ্বিতীয়ত, সাচার কমিটির পর নূতন সমীক্ষার আর দরকার নাই, এই যুক্তিও গ্রহণযোগ্য নয়। পুরাতন সমীক্ষা তাহার ভিত্তি হইতে পারে, কিন্তু নূতন সমীক্ষার প্রয়োজনটি উড়াইয়া দিতে পারে না! এত বড় একটি প্রকল্প, এমন সাধু উদ্যোগে এত বড় খুঁত আক্ষেপের বিষয়।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন