সম্পাদকীয় ১

ব্যক্তিই মূল

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অভিজিত্‌ চক্রবর্তীকে দেখিয়া বঙ্গসমাজের অন্তত একটি অংশের মনে এক গভীর দুঃখ জমিয়াছিল: পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়েরই এমন ভাবে কপাল পুড়িল! জমির উদ্দিন শাহ সেই আফসোস দিব্য ঘুচাইয়া দিয়াছেন। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রমাণ করিলেন, শুধু বাংলার নহে, গোটা দেশের ভাগ্যাকাশেই দুর্যোগের ঘনঘটা। আলিগড়ের প্রধান গ্রন্থাগারটিতে স্নাতক স্তরের ছাত্রীদের প্রবেশাধিকার নাই। নিয়মটি সম্ভবত জমির উদ্দিন শাহ-র উপাচার্য পদে বসিবার পূর্ব হইতেই চলিতেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share:

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অভিজিত্‌ চক্রবর্তীকে দেখিয়া বঙ্গসমাজের অন্তত একটি অংশের মনে এক গভীর দুঃখ জমিয়াছিল: পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়েরই এমন ভাবে কপাল পুড়িল! জমির উদ্দিন শাহ সেই আফসোস দিব্য ঘুচাইয়া দিয়াছেন। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রমাণ করিলেন, শুধু বাংলার নহে, গোটা দেশের ভাগ্যাকাশেই দুর্যোগের ঘনঘটা। আলিগড়ের প্রধান গ্রন্থাগারটিতে স্নাতক স্তরের ছাত্রীদের প্রবেশাধিকার নাই। নিয়মটি সম্ভবত জমির উদ্দিন শাহ-র উপাচার্য পদে বসিবার পূর্ব হইতেই চলিতেছে। বিচক্ষণতার প্রয়োজন নাই, কাণ্ডজ্ঞান থাকিলেই বোঝা সম্ভব, উপাচার্যের কর্তব্য সামান্যই এই একুশে আইনটিকে মুছিয়া ফেলা। কিন্তু তিনি ভিন্ন পথের পথিক। তিনি এই আইনের ব্যাখ্যা প্রদান করিয়াছেন, ছাত্রীরা গ্রন্থাগারে আসিলে (তাহাদের আকর্ষণেই) চতুর্গুণ ছাত্র সেখানে ভিড় জমাইবে। যেহেতু গ্রন্থাগারে তত জনের স্থান সংকুলান হইবে না, অতএব গ্রন্থাগার ছাত্রীদের নাগালের বাহিরে থাকাই বিধেয়। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে ঐতিহ্যমণ্ডিত। সেই ঐতিহ্য পশ্চাদ্মুখিতার নহে, বরং প্রগতিশীলতার। উপাচার্যের বচনামৃতে প্রতিষ্ঠানটির গৌরব বাড়িল না।

Advertisement

সম্প্রতি ভারতে বিবিধ কারণে উগ্র হিন্দুত্ববাদের কিঞ্চিত্‌ রমরমা হইয়াছে। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটি, নামে ‘মুসলিম’ শব্দটির উপস্থিতির কারণেই, সেই হিন্দুত্ববাদীদের নজর কাড়িতে পারে। তাঁহারা বলিতে পারেন, এমত মানসিকতা একটি বিশেষ ধর্মের প্রতীক বহন করিতেছে। এই বিশ্লেষণে সত্যের পরিমাণ তিলমাত্র হইবে কি না, সন্দেহ। অভিজিত্‌ চক্রবর্তী যেমন বাঙালি, হিন্দু বা অন্য কোনও পরিচিতির মাহাত্ম্যে রাতদুপুরে ছাত্র পিটাইতে ক্যাম্পাসে কমান্ডো ডাকেন নাই, তেমনই জমির উদ্দিন শাহ-র মন্তব্যটিও তাঁহার ধর্মের কারণে নহে। সিদ্ধান্তগুলি নিতান্তই ব্যক্তির। অভিজিত্‌ চক্রবর্তী যেমন ব্যক্তি হিসাবে নিজের উপাচার্য হইবার অযোগ্যতা প্রমাণ করিয়াছেন, জমির উদ্দিন শাহ-ও করিলেন। অতএব, প্রশ্ন করিতে হইলে এই ব্যক্তিদের করিতে হইবে, তাঁহাদের মনের চলন কোন বিপজ্জনক পথে, তাহা ভাবিতে হইবে। তাঁহাদের মতো মানুষ কী ভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষপদে আসীন হইতে পারেন, সেই প্রক্রিয়াটিকে প্রশ্ন করিতে হইবে।

অভিজিত্‌ চক্রবর্তীর শিক্ষাগত যোগ্যতা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় প্রতিষ্ঠানের উপাচার্য হইবার যোগ্য কি না, সেই প্রশ্ন আগেই উঠিয়াছিল। তাঁহার গবেষণার কতখানি মৌলিক আর কতখানি কুম্ভীলকবৃত্তির ফসল, সেই প্রশ্নও উঠিতেছে। কিন্তু, তিনি ব্যতিক্রম। প্রায় সব হারাইবার পরেও এইটুকু ভরসা আছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে যোগ্যতাহীনদের নিযুক্তি এখনও নিয়মে পর্যবসিত হয় নাই। কিন্তু, শিক্ষাগত যোগ্যতাই কি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হইবার যথেষ্ট শর্ত? যুক্তি বলিতেছে, না; অভিজ্ঞতাও ভিন্নমত নহে। সুশিক্ষক হইবার জন্যই মানুষ হিসাবে প্রকৃত উদার ও মুক্ত মনের অধিকারী হওয়া বিধেয়। শিক্ষাক্ষেত্রের প্রধান হওয়ার পক্ষে তো বটেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপর মঞ্জুরি কমিশন নামক প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য একেবারেই কাম্য নহে। মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রককেও ছড়ি ঘুরাইবার অধিকার দেওয়ার কোনও কারণ নাই। বিশ্ববিদ্যালয় তাহার নিজস্ব ছন্দে চলিবে। উপাচার্য তাহার প্রধান ছান্দসিক। কাজেই, তাঁহার পরানে যে সুর বাজিছে, তাহার তালটি বুঝিয়া লওয়া অতি প্রয়োজনীয়। অভিজিত্‌ চক্রবর্তী বা জমির উদ্দিন শাহ-রা এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইবেন না। দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও তাঁহাদের সমমনস্করা আছেন কি না, সেই খোঁজ লওয়া ভাল।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement