সম্পাদকীয় ১

ব্যতিক্রমী

রেল বাজেটের দিনটি ‘প্রতিশ্রুতি দিবস’। এই একটি দিন রেলমন্ত্রীর কল্পতরু-ভাব হয়। হাতে ধরা লিখিত নথি হইতে অকাতরে প্রকল্পের পর প্রকল্প, একের পর এক নূতন ট্রেনের কথা গড়গড় করিয়া পড়িয়া যাওয়াই দস্তুর। সেই প্রকল্পগুলির শেষ পর্যন্ত কী হয়, পরম করুণাময় জানিলেও জানিতে পারেন, নেতাদের তাহাতে আগ্রহ নাই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৪ ০০:০০
Share:

রেল বাজেটের দিনটি ‘প্রতিশ্রুতি দিবস’। এই একটি দিন রেলমন্ত্রীর কল্পতরু-ভাব হয়। হাতে ধরা লিখিত নথি হইতে অকাতরে প্রকল্পের পর প্রকল্প, একের পর এক নূতন ট্রেনের কথা গড়গড় করিয়া পড়িয়া যাওয়াই দস্তুর। সেই প্রকল্পগুলির শেষ পর্যন্ত কী হয়, পরম করুণাময় জানিলেও জানিতে পারেন, নেতাদের তাহাতে আগ্রহ নাই। তাঁহারা পরের রেল বাজেটের প্রতিশ্রুতিমালায় মন দেন। রেলমন্ত্রী সদানন্দ গৌড়া জানাইয়াছেন, ভারতে এমন প্রকল্পও আছে, যাহা ত্রিশ বত্‌সর অতিক্রম করিয়াও অসমাপ্ত। গত কাল তাঁহার প্রথম বাজেট ছিল। তাঁহার প্রধানতম কৃতিত্ব, তিনি প্রতিশ্রুতির খেলাটিকে সযত্নে এড়াইয়া গিয়াছেন। বরং, বকেয়া প্রকল্পগুলি যাহাতে শেষ হয়, সে দিকে মন দেওয়ার কথা বলিয়াছেন। ব্যতিক্রমী, নিঃসন্দেহে। রেলভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্তটি পূর্বেই ঘোষিত হইয়াছিল। কেন ভাড়া না বাড়াইলেই নহে, গৌড়া তাহা ব্যাখ্যা করিয়াছেন। যাত্রিভাড়ায় যে ক্ষতি হইত, পণ্য পরিবহণের মাসুল বাড়াইয়া তাহা পূরণের প্রচেষ্টা ভারতীয় রেলের আরও এক দফা ক্ষতি করিতেছিল পণ্য মাসুল বাজারের সহনসীমার অতিরিক্ত হইয়া গিয়াছিল। গৌড়া ভারসাম্যের এই অভাব দূর করিবার কথা বলিয়াছেন। বস্তুত, তাঁহার এই বাজেট ভারসাম্য ফিরাইয়া আনিবার প্রচেষ্টার বাজেট পূর্বসূরিদের ভ্রান্তি সংশোধনের মাধ্যমে, আয়-ব্যয়ের সমতাবিধানের মাধ্যমে, রাজস্বের নূতন উত্‌সসন্ধানের মাধ্যমে।

Advertisement

রেল বাজেটের দিন প্রতিশ্রুতির বন্যার ন্যায় একটি দীর্ঘশ্বাসও ভারতের অভ্যাস হইয়া গিয়াছিল। রেলের ব্যয় ও আয়ের অনুপাতজনিত দীর্ঘশ্বাস। তাঁহার পূর্বসূরিদের ন্যায় গৌড়াও দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিয়াছেন, গত অর্থবর্ষে এই অনুপাত ছিল ৯৪ শতাংশ। এই বত্‌সর অনুপাতটি ৯২.৫ শতাংশে রাখাই তাঁহার লক্ষ্য। অর্থাত্‌, রেল চালাইতে যত টাকা খরচ হয়, তাহার পর উন্নয়নের জন্য এত দিন কার্যত কিছুই অবশিষ্ট থাকিত না, এই বারও থাকিবে না। তাঁহার পূর্বসূরিরা এখানেই থামিয়া যাইতেন। গৌড়া টাকার বিকল্প উত্‌সের সন্ধান করিয়াছেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাবে জানাইয়াছেন, রেলে বেসরকারি বিনিয়োগ চাই। এবং, সেই বিনিয়োগের পাসপোর্ট বিচারের প্রয়োজন নাই। এই বার মন্ত্রিসভা বিজেপি-র প্রাক্-নির্বাচনী ছুতমার্গ কাটাইয়া রেলে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগে সম্মতি জানাইলে মঙ্গল। পাশাপাশি, সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ, এবং রেলের হাতে থাকা সম্পদের বাণিজ্যিক ব্যবহারের মাধ্যমেও টাকার জোগানের প্রস্তাব করিয়াছেন রেলমন্ত্রী। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাবটি নূতন, কিন্তু বাকি কয়টির পিতৃত্ব গৌড়ার পক্ষে দাবি করা কঠিন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই রকম কিছু কথা বলিয়াছিলেন। তিনি সেই কথাগুলিকে কাজে রূপান্তরিত করিতে বিশেষ আগ্রহ দেখান নাই। গৌড়া এখানেই ব্যতিক্রমী হইতে পারেন।

লালুপ্রসাদ যাদব হইতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুকুল রায় প্রত্যেকেই রেলকে ভোটারের মন ভুলাইবার খেলনা হিসাবেই দেখিয়াছিলেন। কিন্তু, তাঁহারা যদি সেই সংকীর্ণতায় বন্দি না-ও হইতেন, যদি নিয়মিত ভাড়া বাড়াইতেন, তবুও কি যাত্রিভাড়াই রেলের কোষাগারে যথেষ্ট টাকা আনিয়া দিতে পারিত? ভারতীয় রেলকে বিশ্বমানের ধারেকাছেও লইয়া যাইতে হইলে যে বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন, শুধু ভাড়ার মাধ্যমে তাহা জোগাড় করা কঠিন। এই বাজেটে তেমনই বেশ কিছু প্রকল্প আছে বুলেট ট্রেন, হীরক চতুর্ভুজ, সাগরমালা ইত্যাদি। রেলমন্ত্রীর সম্মুখে দুইটি পথ ছিল হয় বেসরকারি পুঁজির দ্বারস্থ হওয়া, নচেত্‌ উন্নয়নের স্বপ্ন মুলতবি রাখা। পূর্বতন রেলমন্ত্রীরা দ্বিতীয় পথে হাঁটিতেন। গৌড়া প্রথম পথটি বাছিয়াছেন। আলগোছে নহে, বেশ জোরের সঙ্গেই। তাঁহার এই ব্যতিক্রমী বাজেট কোন গন্তব্যে পৌঁছায়, ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেই ছবিটি আরও স্পষ্ট হইবে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন