সম্পাদকীয় ২

বন্দরের কাল

চাবাহার বন্দর পশ্চিম এশিয়ায় ভারতীয় কূটনীতির সিংহদ্বার হইয়া উঠিবে কি না, তাহা আপাতত অজ্ঞাত। কিন্তু ইরানের এই বন্দর ও তাহার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পরিকাঠামো উন্নয়নে বড় ভূমিকা পালনের জন্য ভারত যে চুক্তি ও অন্যান্য বোঝাপড়া সম্পন্ন করিল, তাহা নিঃসন্দেহে নরেন্দ্র মোদীর একটি গুরুত্বপূর্ণ কৃতি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৬ ০০:০০
Share:

চাবাহার বন্দর পশ্চিম এশিয়ায় ভারতীয় কূটনীতির সিংহদ্বার হইয়া উঠিবে কি না, তাহা আপাতত অজ্ঞাত। কিন্তু ইরানের এই বন্দর ও তাহার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পরিকাঠামো উন্নয়নে বড় ভূমিকা পালনের জন্য ভারত যে চুক্তি ও অন্যান্য বোঝাপড়া সম্পন্ন করিল, তাহা নিঃসন্দেহে নরেন্দ্র মোদীর একটি গুরুত্বপূর্ণ কৃতি। তেরো বছর আগে এই প্রকল্পের কথা শুরু হইয়াছিল, মনমোহন সিংহের দুই দফা রাজত্বে কথা অনেক চালাচালি হইয়াছে, কাজ অগ্রসর হয় নাই। মোদী সরকারের অন্তত চারটি মন্ত্রকের সমন্বয়ের মাধ্যমে যে তৎপরতায় প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়, তাহা কূটনৈতিক এবং সামগ্রিক প্রশাসনের অন্যান্য ক্ষেত্রে দেখা গেলে ভারতের আশা আছে। চাবাহার বন্দর প্রকল্পে যোগদানের জন্য চিনের শাসকরা অধুনা বিশেষ চেষ্টা করিতেছেন, সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রেক্ষিতেও দিল্লির উদ্যোগ সফল। মোদীর ইরান সফর সেই সাফল্যের সূচক।

Advertisement

প্রতিদ্বন্দ্বিতা বহুমাত্রিক। একটি মাত্রা অর্থনীতির। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে জারি-হওয়া আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার দীর্ঘ সময়পর্বে ভারত ইরানের সহিত সুসম্পর্ক বজায় রাখিয়াছিল। তাহার ফলে পেট্রোলিয়ম আমদানি সহ অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দিল্লি তেহরানের নিকট বিশেষ সুবিধা ভোগ করিয়াছে। এখন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত, ফলে বিশেষ সুবিধার জোরে নহে, প্রতিযোগিতার বাজারেই ভারতকে ইরানের সহিত অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রসারের চেষ্টা করিতে হইবে। চাবাহার চুক্তি তাহার একটি সফল দৃষ্টান্ত। নিষেধাজ্ঞা-মুক্ত ইরান আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সহিত লেনদেন যত বাড়াইবে, ততই সেখানে বিনিয়োগের এবং তাহার বাজার দখলের সুযোগ বাড়িবে, আবার প্রতিযোগিতাও বাড়িবে— বিশেষত এক দিকে চিন, অন্য দিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশের সহিত। অর্থাৎ, ভারত ও ইরানের অর্থনৈতিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় এবং চ্যালেঞ্জবহুল।

কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতার গুরুতর মাত্রাটি কূটনৈতিক। পশ্চিম এশিয়ার জটিল এবং সংঘাতবহুল পরিসরে ইরানের ভূমিকা এই মূহূর্তে অ-তুলনীয়। এই অঞ্চলে আধিপত্যের জন্য সৌদি আরবের সহিত তাহার পুরনো রেষারেষি ইয়েমেন, সিরিয়া, ইরাক সহ রণক্ষেত্রগুলিতে নূতন রূপ লইয়াছে। বিশেষত ইসলামিক স্টেট নামক দানবের মোকাবিলায় তেহরানের ভূমিকা উত্তরোত্তর বাড়িয়াছে। কূটনীতির প্রতিযোগিতায় ইরান সৌদি আরবকে অনেকটা পিছনে ফেলিয়া দিয়াছে। ভারতকে একই সঙ্গে ইরান ও সৌদি আরবের সহিত সুসম্পর্ক বজায় রাখিতে হইবে। কাজটি এখন অনেক বেশি কঠিন। অন্য দিকে, আফগানিস্তানে তালিবান আধিপত্য বাড়িতেছে, বকলমে ইসলামাবাদের প্রভাবও। পাকিস্তান ভারতকে আফগানিস্তান হইতে দূরে রাখিতে চাহে। ইরানের লক্ষ্য আফগানিস্তানে পাকিস্তানের প্রভাব নিয়ন্ত্রিত রাখা। পাকিস্তানে চিনের বিপুল বিনিয়োগ এবং পরিকাঠামো নির্মাণের তৎপরতাতেও তেহরানের সন্তুষ্ট হইবার কারণ নাই। বস্তুত, চিনা অর্থে পুষ্ট পাকিস্তানের গ্বাদর বন্দরের ‘প্রত্যুত্তর’ হিসাবেই চাবাহার চুক্তিকে দেখা হইতেছে। আবার চাবাহার বন্দরের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ায় ভারতের বাণিজ্য বৃদ্ধির সম্ভাবনাও বিলক্ষণ। সুতরাং, উভয়েরই উভয়কে প্রয়োজন। এই প্রয়োজনকে কাজে লাগাইয়া দিল্লি কতটা কূটনৈতিক সুবিধা আদায় করিতে পারে, তাহা নরেন্দ্র মোদীর একটি বড় পরীক্ষা।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন