সভ্যতার সহিত বর্বরতার একটি পার্থক্য ইহাই যে, সভ্যতা আপন ঐতিহ্যকে সযত্নে লালন করে, প্রয়োজনে হৃত ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধার করিতেও সচেষ্ট হয়। আর বর্বরতা সেই ঐতিহ্য ধ্বংস করিয়াই হর্ষ লাভ করে। মানবেতিহাসে বারংবার দেখা গিয়াছে বর্বরদের আস্ফালন ও পদচারণা। মধ্য যুগে ধ্বংসের বর্বরতাই বেশি। সাম্প্রতিক ইতিহাসেও তালিবান জঙ্গিদের দেখা মিলিয়াছে, যাহারা আফগানিস্তানের বামিয়ান প্রদেশে দুই হাজার বছরের প্রাচীন পাথরের সুউচ্চ বুদ্ধমূর্তি বোমা দিয়া উড়াইয়া দিয়াছে। ভারতে সাড়ে চার শত বছরের প্রাচীন বাবরি মসজিদ হিন্দু ভৈরবদের শাবল-গাঁইতিতে গুঁড়াইয়া যাওয়ার ঘটনাও বিস্মরণযোগ্য নয়। সর্বশেষ পশ্চিম এশিয়ায় সভ্যতার সুপ্রাচীন নিদর্শনগুলি ধ্বংস করার এক অপরিণামদর্শী মহোৎসব শুরু হইয়াছে। প্রথমে জর্জ বুশের প্রেরিত বাহিনীর তাণ্ডবে ব্যবিলনীয় সভ্যতার অনুপম স্থাপত্য ধূলিসাৎ হয়, লুণ্ঠিত হয় মূল্যবান প্রত্নসামগ্রী। আর এখন ইরাক ও সিরিয়া জুড়িয়া চলিয়াছে ইসলামি রাষ্ট্রবাদীদের ধ্বংসলীলা। ইতিপূর্বে ইরাকের মসুলে ওই জেহাদি বর্বরদের হামলায় আসিরীয় সভ্যতার স্থাপত্য ও ভাস্কর্য ধ্বস্ত, লুণ্ঠিত হইয়াছে। এখন সিরিয়ার পালমিরা নগরী আইএস-এর দখলে, দুই সহস্রাব্দ প্রাচীন রোমক সভ্যতার অবিশ্বাস্য সব পুরাকীর্তি বিনাশের প্রহর গনিতেছে।
এই সংগঠিত ও পরিকল্পিত বিনাশের পিছনে জেহাদিরা একটি জুতসই অজুহাত খাড়া করার চেষ্টা করে— এই সব প্রত্নতত্ত্ব পৌত্তলিক, অতএব ইসলাম-বিরোধী, তাই বিনাশযোগ্য। কিন্তু যাহা ইসলাম-পূর্ব, প্রাক-ইসলামি, তাহা কেমন করিয়া ইসলাম-অনুগামী হইবে! ইসলাম-পূর্ব মানবজাতিও কি সেই যুক্তিতে ইসলাম-বিরোধী নয়? সে ক্ষেত্রে কি ওই পূর্বজদের, তাঁহাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে বিনাশ করিতে হইবে? এই বিচিত্র অপযুক্তি যদি যথার্থই জেহাদিদের বক্তব্য হইত, তাহা হইলে তাহারা লুণ্ঠিত প্রত্নসামগ্রী চোরা-বাজারে চড়া দরে বিক্রয় করিয়া অর্থাগমের চেষ্টা করিত না, সেগুলির বহ্ন্যুৎসব করিত। মানব-প্রজাতির যে নিকৃষ্ট নমুনাগুলি এই জেহাদি শিবিরে নাম লিখাইয়াছে, ধ্বংস, হত্যা, ধর্ষণ, লুঠতরাজের বর্বরতাই তাহাদের অভিজ্ঞান। প্রাক-ইসলামি মানব সভ্যতার ইতিবৃত্তকে যাহারা এই গ্রহের বুক হইতে নিশ্চিহ্ন করিতে চায়, তাহারা কি ভাবিয়াছে, এই প্রক্রিয়ায় তাহারা ইসলামের আধিপত্য বিশ্বময় প্রতিষ্ঠা করিবে? ‘শান্তির ধর্ম’ ইসলাম কি এ ভাবেই বিধর্মীর মুণ্ডচ্ছেদ ও ইসলাম-পূর্ব সভ্যতার নিদর্শন ধ্বংস করিয়া এবং তাহার সচিত্র ভিডিও প্রতিবেদন প্রচার করিয়া আপনাকে জনসাধারণের কাছে প্রিয়, শ্রেয় ও গ্রহণযোগ্য করিয়া তুলিবে?
নভেম্বর বিপ্লবের পর জারের প্রাসাদ ও মূর্তি ধ্বংসে উদ্যত বলশেভিক জনতাকে নিরস্ত করিয়া ভ্লাদিমির ইলিচ বলিয়াছিলেন— জারতন্ত্রের স্বৈরাচারের নিদর্শন হিসাবে এগুলি সংরক্ষিত হউক, যাহাতে পরবর্তী প্রজন্ম সেই স্বৈরাচারের প্রত্যাবর্তনের দুঃস্বপ্ন না দেখে। ইহাই একজন সভ্য রাষ্ট্রনায়কের দৃষ্টিভঙ্গি। ইসলামি রাষ্ট্রবাদীরা কেবল অ-ইসলামি স্থাপত্য-ভাস্কর্য, সভ্যতাই ধ্বংস করিয়া ক্ষান্ত হইতেছে না, তাহার নির্মাতাদের বর্তমান উত্তরাধিকারীদেরও নির্মূল করিতেছে। গলার নলি কাটিয়া মানব-পশুকে হালাল করার সেই দৃশ্য সযত্নে চলচ্চিত্রায়িত করিয়া তাহা আবিশ্ব ছড়াইয়া দিবার মধ্যে যে অমানবিক বর্বরতা রহিয়াছে, তাহাই ইহাদের অভিজ্ঞান।