সাক্ষাত্কার

বড় সাফল্যের পরে এ বার বড় পরীক্ষা

চট করে গ্রোথ রেট বাড়ানোর চেষ্টাটা একটা ঝুঁকির ব্যাপার। তার সঙ্গে যদি চাপ দেওয়া হয় যে ভর্তুকি কমাতে হবে, সামাজিক ব্যয় কমাতে হবে, সেটা মেনে নিলে তার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সামলানো যাবে কি? প্রশ্ন তুলেছেন সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এ যুক্ত সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সাক্ষাৎকার নিলেন অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়। চট করে গ্রোথ রেট বাড়ানোর চেষ্টাটা একটা ঝুঁকির ব্যাপার। তার সঙ্গে যদি চাপ দেওয়া হয় যে ভর্তুকি কমাতে হবে, সামাজিক ব্যয় কমাতে হবে, সেটা মেনে নিলে তার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া সামলানো যাবে কি? প্রশ্ন তুলেছেন সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এ যুক্ত সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সাক্ষাৎকার নিলেন অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৪ ০৪:০৭
Share:

বিজয়ী। দলীয় সাংসদদের সামনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই

তিরিশ বছর পরে একটা দল একাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। অনেকে বলছেন, জোট রাজনীতির প্রতি মানুষ বীতশ্রদ্ধ, এখন আবার উল্টোরথের যাত্রা শুরু হল।

Advertisement

আমার তা মনে হয় না। বিজেপির এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা কিন্তু উত্তর এবং পশ্চিম ভারতের ব্যাপার, দক্ষিণ আর পূর্ব ভারতে আঞ্চলিক দলগুলো নিজেদের শক্তি যথেষ্ট বজায় রেখেছে। যেটা ঘটেছে, তা হল কংগ্রেসের বিপর্যয়। উত্তরপ্রদেশে, বিহারে, কিছুটা মহারাষ্ট্রে, কংগ্রেস যে ভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, সেটা না হলে বিজেপির এই ফল হতে পারত না। ২০০৯-এ কংগ্রেস আর বিজেপি মিলে পেয়েছিল ৩২২টি আসন, এ বার পেয়েছে ৩২৬টি। এই দিক থেকে দেখলে, মিলিত ভাবে আঞ্চলিক দলগুলোর শক্তি যা ছিল, তা-ই আছে। আসলে যেটা হয়েছে, কংগ্রেস একটা আঞ্চলিক দলের মতো হয়ে গেছে। বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতায় তারই প্রতিফলন ঘটেছে। এখন প্রশ্নটা দাঁড়াচ্ছে এই যে, একদলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা কি তবে একটা সাময়িক ব্যাপার? এ-রকম কিছু দিন চলবে, তার পর আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে? আমার নিজের ধারণা, এই সরকার কী করতে পারে বা না পারে, এর উত্তরটা অনেকটা তার ওপর নির্ভর করছে।

এই নির্বাচনে একটা জিনিস আমার সবচেয়ে অভিনব বলে মনে হয়েছে। ভারতের নির্বাচনে বড় ব্যবসায়ীরা একটা দলকে একেবারে ফেলে দিয়ে আর একটা দলের দিকে পুরোপুরি ঝাঁপিয়ে পড়ল, এটা অন্তত আমার স্মরণে আগে কখনও হয়নি। তারা সব সময়েই একটা ভারসাম্য রেখে চলে। যখন কোনও একটা পক্ষের প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন থেকেছে, তখনও সবাই একবাক্যে এক দিকে ঝুঁকে পড়েনি। এ বার দেখলাম, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো থেকে শুরু করে নামজাদা বড় ব্যবসায়ীরা সবাই অকপট ভাবে নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে দাঁড়িয়ে গেলেন। বিজেপি নয়, তাঁরা পরিষ্কার বলেছেন তাঁরা মোদীর পক্ষে। মানে, হিন্দুত্ব ইত্যাদি যে তাঁরা বিরাট ভাবে সমর্থন করেন তা নয়, কিন্তু মোদীর যে ডেভেলপমেন্ট মডেল, গুজরাতে তিনি যা করেছেন, তাঁরা সেটার জন্যে তাঁকে চাইছেন।

Advertisement

দ্বিতীয়ত, ভারতের মিডিয়ার, বিশেষ করে টেলিভিশন মিডিয়ার প্রভাব অনেক দিন ধরেই বাড়ছে। আমার মনে হয়, এ বারের নির্বাচনে সেই প্রভাবটা সবচেয়ে বেশি দেখা গেল।

এবং সেটা কেবল শহরে নয়।

একেবারেই না, টেলিভিশনের তো এখন গ্রামে খুবই প্রভাব। এবং এটা শুধু ইংরেজি নিউজ চ্যানেলের ব্যাপার নয়। প্রত্যেকটা অঞ্চলে তো বহু আঞ্চলিক চ্যানেল কাজ করছে। এই সব জায়গায়, বিজ্ঞাপন সংস্থার মাধ্যমেই হোক, সরাসরি বিজেপি থেকেই হোক, একটা বিরাট প্রচার হয়েছে। ওই যে বারে বারে আমেরিকার প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছিল, সেটার পিছনে তো বিরাট ভাবে মিডিয়াকে বিরাট ভাবে ব্যবহার করা হয়। গোটা নির্বাচনটাকে মোদী বনাম অন্যরা— এই ভাবে দাঁড় করানো হয়েছে। এর পিছনেও বড় ব্যবসার এক বিরাট ভূমিকা ছিল।

এখন, এটা যদি হয়ে থাকে, তা হলে আমার ধারণা, এই সরকারকে প্রথম কিছু দিনের মধ্যেই বড় ব্যবসায়ীদের খুশি করার জন্য কিছু জিনিস করে দেখাতে হবে। তার কিছু কিছু আন্দাজ আমরা ইতিমধ্যেই পাচ্ছি। সরকার তৈরি হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই নরেন্দ্র মোদী এবং অরুণ জেটলি দুজনেই বলেছেন যে, আমাদের কিছু হার্ড ডিসিশন নিতে হবে এবং তাতে সকলে খুশি হবে না, সকলকে খুশি করতে পারব না। এখন, অভিজ্ঞতা থেকে বার বারই দেখা গেছে যে, যখন গ্রোথ বেশি হয়, তখন অসাম্যও বেড়ে যায়। ভারতেও গত দশকের প্রথম পাঁচ-সাত বছরে এটাই দেখা গেছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, এটা হওয়ারই কথা। কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে তো এর মোকাবিলা করতে হবে। সেটা কী ভাবে করা হবে, সেটাই প্রশ্ন।

আর একটা ব্যাপার আছে। আমাদের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অর্থনীতি সংক্রান্ত যে বড় বড় সিদ্ধান্তগুলো, শিল্প নীতি বা মনিটারি পলিসি ইত্যাদি, সেগুলো কেন্দ্রের হাতে। কিন্তু তার যে পরিণাম, যে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া, সেগুলো তো রাজ্য সরকারের স্তরে, আঞ্চলিক স্তরে দেখা যাবে। সেখানকার রাজনৈতিক লোকদের সেটা সামলাতে হবে। ইউপি এ আমলে যে সব রাজ্যে কংগ্রেসের সরকার সেখান থেকেই তো চাপ এসেছিল যে— আমরা সামলাতে পারছি না। সুতরাং ওই নানা রকমের সামাজিক ব্যয়, খাদ্য নিরাপত্তা, রোজগার গ্যারান্টি, এই সব করতে হয়েছে। এটা তো বিজেপির ক্ষেত্রেও হবে।

বড় ব্যবসায়ীদের ধারণা হল, এই সামাল দেওয়াটাই রাজনৈতিক নেতার কাজ। তাদের বক্তব্য, এমন নীতি নাও যাতে গ্রোথ বাড়ে। তার থেকে বাড়তি রাজস্ব মিলবে। তার একটা অংশ সামাজিক খাতে খরচ করো, পরিস্থিতিটা রাজনৈতিক ভাবে সামাল দাও, যাতে সেটা হাতের বাইরে না চলে যায়, অশান্তি বেশি না হয়। তাঁরা ধরে নিচ্ছেন মোদী এটা ভাল করে করতে পারবেন। তাঁর সম্বন্ধে বার বার বলা হচ্ছে ‘স্ট্রং লিডার’। এই কথাটার মানে হচ্ছে যে, ওঁর কথা লোকে শুনবে, দলের মধ্যে মানবে, তাই উনি এটা ম্যানেজ করতে পারবেন। এটাই সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। এবং দু’তিন বছরের মধ্যেই বোঝা যাবে এটা কতটা করতে পারা যাচ্ছে বা যাচ্ছে না।

গ্রোথ রেট চট করে বাড়ানোর জন্যে অনেক কিছু করতে হবে। এই তো জগদীশ ভগবতীর মতো অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জমি অধিগ্রহণ সহজ করা দরকার। কিংবা শ্রম আইন সংস্কার। বলা হচ্ছে, সংগঠিত শিল্পে শ্রম আইন আলগা করে দাও, তা হলে অনেক বেশি লগ্নি হবে, দক্ষতা বাড়বে, গ্রোথ হবে। এবং এঁদের এক ধরনের যুক্তিও আছে যে, বর্তমান শ্রম আইনের ফলে সংগঠিত শিল্পের শ্রমিকরা সুবিধাভোগী শ্রেণি হয়ে গেছে। তারা আর কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না, ফলে ইনফর্মাল সেক্টর বেড়েই চলেছে। ওঁদের বক্তব্য, তুমি যদি সংগঠিত শিল্পকে স্বাধীনতা দাও, তা হলে সেখানে হয়তো মজুরি কমবে, কিন্তু অনেক বেশি লোক সেখানে কাজ পাবে।

এর পরিণামে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে...

একেবারেই। চট করে গ্রোথ রেট বাড়ানোর চেষ্টাটা একটা ঝুঁকির ব্যাপার। এর প্রতিক্রিয়া রাজনৈতিক ভাবে সামলানো যাবে কি না, সে প্রশ্ন থাকবেই। তার সঙ্গে তুমি যদি চাপ দিতে থাকো যে, ভর্তুকি কমাতে হবে, সামাজিক ব্যয় কমাতে হবে, নরেগা-র মতো এত সব খরচ করা চলবে না, সেটা মেনে নিলে রাজনৈতিক হিসেব মেলানো যাবে কি? এটাই আমার মতে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

এক দিক থেকে এ একটা এক্সপেরিমেন্টও বটে। শেষ এ-রকম একটা এক্সপেরিমেন্ট হয়েছিল রাজীব গাঁধীর সময়ে। ১৯৮৪ সালে তিনি বিরাট ব্যবধানে জেতার পরে কিছু দিন মনে হয়েছিল, বড় ব্যবসায়ীরা যেমন চান সে-রকম নীতি নেওয়া হবে। সরকার তার কিছু চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু বেশি দিন টেকেনি। রাজনীতির চাপেই বোঝা গেল এটা বেশি দিন করা যাবে না।

কিন্তু এই চাপ দেওয়ার জন্য যে গণতান্ত্রিক রাজনীতির দরকার, বিশেষ করে সংগঠিত বামপন্থী রাজনীতি, এখন তো তা বেশ দুর্বল। চাপটা তেমন জোরদার হবে কি?

গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলতে, বামপন্থী রাজনীতি বলতে সাধারণ ভাবে যা বোঝায়, তার দিক থেকে দেখলে সত্যিই দুর্বল। কিন্তু যদি ভাবো, গণতান্ত্রিক রাজনীতি বলতে কী বোঝায়, এই যে মানুষ ভোট দেয়, কেন ভোট দেয়, কী প্রত্যাশা নিয়ে ভোট দেয়? এইখানে আমার মতে গত বিশ ত্রিশ বছরে বড় একটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। এবং বামপন্থীদের অবনতির কথা যদি বলো, আমার ধারণা তার কারণটা এই জায়গাটায় লুকিয়ে আছে। বামপন্থীরা এই পরিবর্তনের চরিত্রটা এখনও ঠিক করে বুঝতে পারেনি।

এটা আর একটু বুঝিয়ে বলবেন?

দেখ, ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে ইউরোপে বামপন্থী বলতে বোঝানো হত যে, এক দিকে একটা ইনডাস্ট্রিয়াল ক্যাপিটালিজম আছে, যারা তার ভুল ত্রুটি অন্যায় ইত্যাদি দেখিয়ে দেয়, তারাই হচ্ছে বামপন্থী। এখান থেকেই বামপন্থা উঠেছিল। এবং তার একটা প্রধান কথা ছিল যে, এক দিকে লেবার আছে, আর এক দিকে ক্যাপিটাল। ফলে শিল্পোন্নত দেশে যত বেশি শ্রমিক শ্রেণির সমাবেশ করতে পারা যাবে, বামপন্থী রাজনীতি তত জোরদার হবে। এ ভাবেই ক্রমশ শ্রমিকের ভোট দেওয়া, তার পর মেয়েদের ভোট দেওয়া, এই সবের মধ্যে দিয়েই আমরা গণতান্ত্রিক রাজনীতির একটা ধারণা তৈরি করেছি। কিন্তু মোদ্দা কথাটা হল, পুঁজিবাদের সমালোচনাকেই আমরা মূলত বামপন্থা বলে ধরে নিয়েছি।

এ বারে ভারতে, বিশেষ করে লিবারালাইজেশনের পরে পুঁজিবাদের যে চেহারা, সেটা কিন্তু একেবারে অন্য রকম। ইউরোপে যে ভাবে ক্যাপিটালিজম এসেছিল তার সঙ্গে এটা মিলবে না। ধরো গত শতাব্দীর শেষ থেকে টানা অনেক দিন ধরে প্রতি বছর সাত, আট, নয় পারসেন্ট গ্রোথ হয়েছে আমাদের দেশে, তার ফলে অনেকেরই আয় বেড়েছে। এমনকী এটাও মেনে নেওয়া যায় যে, আগের থেকে দারিদ্রের মাত্রা কিছুটা কমেছে। কিন্তু এই সময়ে সংগঠিত শিল্পে কর্মসংস্থান একেবারেই বাড়েনি। লক্ষ করলে দেখবে, পুঁজিবাদ এখানে যে ভাবে কাজ করছে, তাতে এক দিকে গ্রোথ হচ্ছে, অন্য দিকে পুরনো শিল্পের যে কাঠামো, সেটা ভেঙে যাচ্ছে। কৃষি বলো, কারিগরি শিল্প বলো, সেগুলো থেকে মানুষের জীবনধারণ করা আর সম্ভব হচ্ছে না। এবং আগে আমরা যেটা জানতাম যে, কৃষি থেকে উদ্বৃত্ত শ্রমিক এসে শিল্পশ্রমিক হয়, কারণ শিল্প বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকের চাহিদা বাড়ে, এখন আর সেটা হচ্ছে না। এখন নতুন ক্যাপিটাল অন্য জিনিস চাইছে। এই যে, অনেকেই বলছে, চটকলে আধুনিক প্রযুক্তি আনা হচ্ছে না বলে এ-রকম হচ্ছে। এখন, চটকল যদি আধুনিক হয়, তা হলে তো আর হাজার হাজার শ্রমিক লাগবে না। মানে শিল্পের গ্রোথ হয়তো হবে, কিন্তু তাতে কর্মসংস্থান তো বাড়বে না। এই অবস্থায় বহু মানুষ, আগে যারা শিল্পশ্রমিক হত, এখন তারা কোনও রকমে এটা ওটা জোগাড় করে জীবনধারণ করছে। অর্জুন সেনগুপ্ত কমিশনের রিপোর্ট দেখলাম, সেখানেও এটা পরিষ্কার। এবং এগুলোর কোনওটাই কিন্তু পুরনো ধরনের কাজ নয়, এ সবই পুঁজিবাদের প্রসারের একটা নতুন চেহারা।

এই বারে, বামপন্থীরা চিরকাল ভেবে এসেছেন যে, পুঁজিবাদের সমালোচনা মানে হচ্ছে, শ্রমিক শ্রেণিকে সংগঠিত করতে হবে। তার সঙ্গে চিন বা ভারতের মতো দেশে একটা বিরাট বড় কৃষি অর্থনীতি আছে, সেখানে যে বিরাট বিরাট জমির মালিক আছে, তাদের বিরুদ্ধে ছোট এবং মাঝারি কৃষকদের সংগঠিত করতে হবে...

যে কারণে কৃষক সভা হল, খেতমজুর সংগঠন হল...

এটাই ছিল এ দেশে চিরাচরিত বামপন্থা। এখন, সেই অর্থনীতিটা পালটে গেছে। পুরনো জমির মালিকানার কাঠামো পালটে গেছে। কয়েকটা জায়গা বাদ দিলে সেই বিশাল বিশাল জমির মালিক আর নেই। সত্তরের দশকে আশির দশকে যাদের জোতদার বলতাম, তারাও আর সেই জোতদার নেই। দেখা যাবে জোতদারের ছেলেরা এখন শহরে কাজ করে, ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা করে, অন্য কিছু করে। ২০১১’র সেনসাস বলছে, গ্রামে থাকে, কিন্তু কৃষিতে নেই বা অন্তত কৃষি মূল জীবিকা নয়, এ-রকম মানুষের সংখ্যা প্রচুর বেড়ে গেছে। এখন, ভারতবর্ষের বামপন্থীদের তত্ত্বে পুঁজিবাদের সমালোচনা যে ভাবে করা হত বা ভাবা হত, তার মধ্যে এই নতুন পরিস্থিতিতে উঠে আসা নতুন প্রশ্নগুলোর উত্তর নেই।

একেবারে হাতেকলমে যে রাজনীতিটা চলে, তাতে কিন্তু কতকগুলো উত্তর এসেছে। যেমন, যারা কিছু পায় না, পায়নি, সরকারি টাকা থেকে তাদের কিছু পাইয়ে দেওয়া। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের আমলে এটা হয়েছে, যেমন পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে। প্রথম দিকে, ভূমি সংস্কারের পরে প্রথম ধাক্কায় ছোট চাষির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছিল, টিউবওয়েল বসিয়ে, বীজ বা সার দিয়ে, খানিকটা সরকারি সাহায্য দিয়ে... ফলে ছোট চাষি এক বারের জায়গায় তিন বার ফসল করতে পারল, খেতমজুরও সারা বছর কাজ পেল, আয় বাড়ল। আশির দশকে পশ্চিমবঙ্গে যে মোটামুটি একটা সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হল, তার মূলে তো এটাই ছিল। কিন্তু এটা তো বেশি দিন চলে না। ক্রমশ কৃষির বৃদ্ধি কমতে শুরু করল, ছোট জমি ভাগ হয়ে আরও ছোট হল। তখন আবার চেষ্টা হল, শিল্পে মন দাও। সেটা করতে গিয়ে তো একেবারে বিপর্যয় হয়ে গেল। কিন্তু আশির দশকের শেষ দিক থেকে নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিক পর্যন্ত দেখেছি, গ্রামে যারা আগে কিছুই পেত না, পঞ্চায়েতের মাধ্যমে তাদের কাছে নানা রকম জিনিস পৌঁছে দেওয়া হল।

আঞ্চলিক দলগুলো কিন্তু এই ব্যাপারটাতে খুব জোর দিয়েছিল। যেমন তামিলনাড়ুতে দুটো প্রধান আঞ্চলিক দলই দু’টাকা কিলো চাল থেকে শুরু করে নানা ধরনের সরকারি সাহায্য দিয়ে এসেছে। এ ধরনের চেষ্টা প্রত্যেকটা আঞ্চলিক দল করেছে। এখানে তৃণমূল কংগ্রেস এটা অত্যন্ত ভাল ভাবে করছে। এর পিছনে কোনও বড় আইডিয়োলজি নেই, ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনও ভাবনা নেই, সমস্ত ব্যাপারটা হচ্ছে, আমি বাজেটের কোথা থেকে কতটুকু টাকা কী ভাবে বিতরণ করে দিতে পারব। এটা সম্পূর্ণ ভাবে ইনস্ট্রুমেন্টাল, মানে আমি আগামী ভোটটা কী ভাবে পার করতে পারব, ব্যস। বামপন্থীরাও শেষের দিকে এখানেই পৌঁছে গিয়েছিল।

এ বার, বামপন্থীদের হাত থেকে যখন ক্ষমতা চলে গেল, তখন অসুবিধে হয়ে গেল। মানুষ তো ধরেই নিয়েছে, কে আমাকে কী দিতে পারবে, সেই অনুসারে ভোট দেব। এই যে দলে দলে লোকে সিপিএম থেকে তৃণমূলে যাচ্ছিল, এখন বিজেপিতে যাচ্ছে, তারা তো পরিষ্কার বলছে, সিপিএম আমাদের কিছু দিতে পারবে না, তৃণমূলের হাত থেকে বাঁচাতেও পারছে না, তা হলে যার ক্ষমতা নেই, তার কাছে থেকে লাভ কী? যার ক্ষমতা আছে তার কাছেই যাই। এ তো একেবারে সাফ সাফ বলছে, কোনও রাখঢাক না করে। এর মানে এটাও নয় যে, সবাই হঠাৎ দলে দলে খুব হিন্দু হয়ে যাচ্ছে। এটা একেবারেই পাওয়া না পাওয়ার হিসেব।

বামপন্থীদের যে ঝোঁকটা ছিল, নির্বাচনী রাজনীতিতে থেকেও... একটা সময় বামপন্থীরা বলতে পারত, পুলিশের হাতে মার খেলেও আমাদের দলের লোকেরা পালায় না। যার পিছনে আইডিয়োলজির একটা ভূমিকা ছিল। একটা বিশ্বাস ছিল যে, আমরা একটা বড় কিছুর জন্যে লড়ছি। আজকে আমরা হেরে গিয়ে থাকতে পারি, আমাদের কষ্ট করতে হবে, কিন্তু ভবিষ্যতে আমরা কোথাও একটা যাব। কিন্তু এইটাই তো নষ্ট হয়ে গেল। একটা বামপন্থী দলকে ধরে রাখার জন্যে আইডিয়োলজির যে ভূমিকাটা ছিল, সেটাই তো ছেড়ে দেওয়া হল। ধরেই নেওয়া হল যে, আমরা ক্ষমতায় আছি, আমরা সরকারি দল, লোকে আমাদের কাছে আসবে, ব্যস। সেই ভাবেই পার্টিতে লোক নেওয়া শুরু হল। এ বার পার্টি যখন ক্ষমতায় নেই তখন তারা চলে যাবে, তাতে তো অবাক হওয়ার কিছু নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন