হাকিম নড়িবার আগেই সম্ভবত হুকুম নড়িতে চলিয়াছে। বারাক ওবামা ২০১৬ সালের মধ্যে আফগানিস্তান হইতে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিয়াছিলেন। সেই অনুসারে কাজও চলিতেছে। উদ্বিগ্ন সমালোচকরা আপত্তি জানাইয়াছেন যে, ওয়াশিংটন হাত গুটাইয়া লইলে আফগানিস্তান আবার গোষ্ঠীসংঘাতে বিধ্বস্ত হইবে এবং ফিরিয়া আসিবে তালিবানি আধিপত্য। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্টের এক কথা: আফগানিস্তানের স্থানীয় শক্তিগুলিকে প্রশিক্ষণ এবং সাহায্য দানই মার্কিন স্বার্থ চরিতার্থ করিবার শ্রেষ্ঠ পথ, সরাসরি নিজস্ব সেনা মোতায়েন নয়। গত বছর ওয়েস্ট পয়েন্ট তথা সামরিক অ্যাকাডেমিতে এক বক্তৃতায় তিনি আপন নীতির সারাত্সারটি বুঝাইয়া বলিয়াছিলেন, ‘সেনা না পাঠাইয়া আমাদের নাগাল বিস্তার করাই’ লক্ষ্য, সে জন্য ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে স্থানীয় শক্তিকে পাশে চাই।’ আদর্শ হিসাবে উত্কৃষ্ট, জর্জ ডব্লিউ বুশের রণহুঙ্কার দিয়া ঝাঁপাইয়া পড়িবার ঐতিহ্য অপেক্ষা সুচিন্তিত।
কিন্তু পরিস্থিতি বিরূপ। আফগানিস্তানের পরিণতি সম্পর্কে সমালোচকদের উদ্বেগ সত্য প্রমাণিত হইতেছে। বিভিন্ন এলাকায় তালিবান আধিপত্য বর্ধমান। অবশেষে উত্তরাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ শহর কুন্দুজ তালিবান দখলে চলিয়া যাওয়ার পরে আফগানিস্তানে মোতায়েন নেটো বাহিনীর কর্ণধার সাফ জানাইয়া দিয়াছেন, সে দেশের নিরাপত্তা বাহিনী এখনও প্রতিরক্ষার দায়িত্ব বহনে প্রস্তুত নহে, আরও সময় লাগিবে। এই অভিমতের অনিবার্য অনুসিদ্ধান্ত হিসাবেই তাঁহার মন্তব্য ছিল, সেনা অপসারণের সিদ্ধান্ত স্থির করিবার সময় প্রেসিডেন্ট ওবামা বাস্তব পরিস্থিতির সম্পূর্ণ হিসাব কষেন নাই। এই ভাবেই সেনা অপসারণের নীতি পরিবর্তনের ক্ষেত্র ও যুক্তি প্রস্তুত হইতেছিল। অবশেষে মুখ খুলিয়াছেন মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব অ্যাশ কার্টার। তাঁহার বক্তব্য: সেনা অপসারণের প্রশ্নে তাঁহারা নমনীয় মনোভাব পোষণ করিতেছেন, অবস্থা বুঝিয়া এ বিষয়ে পরিকল্পনায় রদবদল হইতে পারে, নেটো যেন প্রস্তুত থাকে। কূটনীতির ভাষা পাঠ করিতে কিছুমাত্র অসুবিধা নাই। আড়াই বছর আগে আফগানিস্তান ছাড়িবার যে সিদ্ধান্ত ওবামা স্থির করিয়াছিলেন, তাহা বজায় রাখা কঠিন।
ইতিপূর্বে ইরাকেও অনুরূপ সমস্যায় পড়িয়াছে ওয়াশিংটন। ২০১১ সালে সেই রণাঙ্গন হইতে সরিয়া আসিবার পরে প্রথম কিছু কাল ইরাকের পরিস্থিতি আপাত-নিয়ন্ত্রিত ছিল। ওবামা আপন নীতির সাফল্যে শ্লাঘা প্রকাশ করিয়াছিলেন। অতঃপর ঈশান কোণে ইসলামিক স্টেট-এর অভ্যুদয়, দেখিতে দেখিতে তাহার অতিকায় বিস্তার। ওবামাকে অগত্যা ইরাকে প্রথমে সামরিক ‘উপদেষ্টা’ প্রেরণ করিতে হয়, তাহার পরে ক্রমে বোমারু বিমান। পদাতিক সৈন্য পাঠাইবার সম্ভাবনা এখনও কম, কিন্তু আইএস-এর তাড়নায় সেই সম্ভাবনাও দ্রুত বাড়িতে পারে। অর্থাত্ ওবামার নীতি এবং বাস্তব অবস্থার মধ্যে বিবিধ অঞ্চলেই দূরত্ব বাড়িতেছে। কোদালকে কোদাল বলিতে হইলে ইহার অর্থ: তিনি ইরাক বা আফগানিস্তানের বাস্তব বুঝিতে ভুল করিয়াছেন। সিরিয়াতেও তিনি ব্যর্থ, যে ব্যর্থতার সুযোগে ভ্লাদিমির পুতিন আপন গুরুত্ব বাড়াইতেছেন। হোয়াইট হাউসে বারাক ওবামার মেয়াদ আর সওয়া এক বৎসর। বহুমুখী সন্ত্রাসের প্রসার দমনের পক্ষে সময়টি অল্প, কিন্তু সেই সন্ত্রাসের মোকাবিলায় দিশাহারা হইয়া রণনীতির হাল ছাড়িয়া দিবার পক্ষে বিলক্ষণ সময় তাঁহার হাতে আছে। ইতিহাস নির্মম, ওবামা তাহা নিশ্চয় জানেন।