মানুষের মনে কী ধারণা জন্মাচ্ছে তা জানাও জরুরি

সত্‌ বলে নেতাদের বা দলকে প্রতিভাতও হতে হয়। মমতা-সরকার সম্পর্কে গত তিন বছরে এই ধারণায় একটা চিড় ধরেছে। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালরাজনীতিতে পারসেপশন বা আমজনতার মনের মধ্যে তৈরি হওয়া ধারণা বড় ভয়ঙ্কর এক ঘটনা। পৃথিবীর ইতিহাসে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তাঁদের জীবনযাত্রার বহু অনুষঙ্গ যেমন যুক্ত হয়ে থাকে, তেমনই তাঁদের সম্পর্কে মানুষের যে ধারণা তৈরি হয়, তার বৃত্তে সেই নেতা অনেক সময় নিজেই বন্দি হয়ে যান। সেই ধারণায় যখন আঘাত লাগে, যখন সেই জনমতের বার্লিন প্রাচীর ভেঙে যায়, তখন সৃষ্টি হয় এক নতুন মহাভারত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:০০
Share:

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

রাজনীতিতে পারসেপশন বা আমজনতার মনের মধ্যে তৈরি হওয়া ধারণা বড় ভয়ঙ্কর এক ঘটনা।

Advertisement

পৃথিবীর ইতিহাসে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তাঁদের জীবনযাত্রার বহু অনুষঙ্গ যেমন যুক্ত হয়ে থাকে, তেমনই তাঁদের সম্পর্কে মানুষের যে ধারণা তৈরি হয়, তার বৃত্তে সেই নেতা অনেক সময় নিজেই বন্দি হয়ে যান। সেই ধারণায় যখন আঘাত লাগে, যখন সেই জনমতের বার্লিন প্রাচীর ভেঙে যায়, তখন সৃষ্টি হয় এক নতুন মহাভারত। চার্চিলকে যেমন তাঁর চুরুট ছাড়া ভাবা যায় না, ঠিক সে ভাবেই আমাদের প্রমোদ দাশগুপ্ত ও অতুল্য ঘোষকেও ভাবা যায় না। এগুলি রাজনৈতিক চরিত্রের অনুষঙ্গ, যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীল হাওয়াই চটি!

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৮৪ সালে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে পরাস্ত করার পর দেখা করতে গিয়েছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেনের সঙ্গে। সে দিন সাংবাদিক হিসেবে গিয়েছিলাম প্রফুল্ল সেনের বাড়ি। নিজের চোখে দেখেছিলাম মৃত্যুপথযাত্রী সেই অশীতিপর বৃদ্ধ ঠিক কী ভাবে তাঁর জীবনযাত্রা নির্বাহ করেন। সহজ সরল অনাড়ম্ভর গাঁধীবাদী এক নেতা ছিলেন প্রফুল্ল সেন। এমন অবস্থা ছিল সে সময় যে চিকিত্‌সার সমস্ত খরচও তাঁর নিজের পক্ষে বহন করা সম্ভব হচ্ছিল না। অথচ এই প্রফুল্ল সেনের বিরুদ্ধে রাজ্যের বামপন্থীরা একসময়ে প্রচার চালান, তিনি না কি স্টিফেন হাউস-ই কিনে নিয়েছেন। সে অভিযোগ শেষ পর্যন্ত প্রমাণ হয়নি। কিন্তু আরামবাগের মতো নির্বাচন কেন্দ্রে ১৯৬৭-র ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি আটশো ভোটে বাংলা কংগ্রেস সভাপতি অজয় কুমার মুখোপাধ্যায়ের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। কলকাতার কোনও বাজারে না কি সে দিন কাঁচকলা পাওয়া যায়নি। দু’গুণ দামে কাঁচকলা বিক্রি হয়েছিল। কারণ, কলকাতার তীব্র মূল্যবৃদ্ধির বাজারে তিনি কাঁচকলা সস্তা বলে সেটি খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন মানুষকে। তাতে বাংলার আমজনতার সমাজে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়।

Advertisement

আচ্ছা বলুন তো, ১৯৮৪ সালের ‘মিস্টার ক্লিন’ রাজীব গাঁধী কী ভাবে তিন-চার বছরের মাথায় ‘বফর্স গাঁধী’তে পরিণত হয়েছিলেন? রাজীব গাঁধী যে বফর্স কেলেঙ্কারিতে যুক্ত ছিলেন, এমনটা কিন্তু আজও প্রমাণিত হয়নি। উল্টে, মৃত্যুর আগে বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ তো বফর্স নিয়ে সনিয়া গাঁধীর কাছে কার্যত দুঃখপ্রকাশ করেন। অথচ ভারতের একটি লোকসভা নির্বাচন তো বফর্স নামক একটি শব্দতেই হয়ে গিয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তি ছিল ঠিক এমনই নিষ্কলুষ। তিনি রাজ্যে আমজনতার প্রতিনিধি। পায়ে নীল হাওয়াই চটি। সুতির অতি সাধারণ শাড়ি। ভোগ-বিলাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গে মমতা ছিলেন সততা ও নির্ভীকতার প্রতীক। ৩৪ বছরের যে দীর্ঘ সিপিএম শাসন, সে শাসনেও দুর্নীতির ঘুণ ধরেছিল। মমতা সেই ঘুণ ধরা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছিলেন এক জীবন্ত জিহাদ।

তিন বছর ক্ষমতায় থাকার পর এখন সেই মমতার সরকার সম্পর্কে অভিযোগের তর্জনী উঠেছে। মূলত সারদা কেলেঙ্কারির সিবিআই তদন্তে রাজ্যের কতিপয় নেতা, মন্ত্রী ও সাংসদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তৃণমূলের এই নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় বিজেপি রাজ্য জুড়ে প্রচার শুরু করেছে যে মমতার সরকারও ভ্রষ্ট। জ্যোতি বসুর আমলে তাঁর পুত্র চন্দন বসুকে ঘিরে অনেক অভিযোগ উঠেছিল। বেঙ্গল ল্যাম্প কেলেঙ্কারির কথা আমরা ভুলিনি। অভিযোগ ওঠে, পূর্ত দফতর বেআইনি ভাবে চন্দন বসুর ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের সুযোগ পাইয়ে দিয়েছে। কিন্তু তখন জ্যোতি বসু কী করেছিলেন? যতীন চক্রবর্তীকেই মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করেছিলেন জ্যোতিবাবু। সেই দুর্নীতির জন্য জ্যোতি বসু নিজেকে দূরে রেখেছিলেন এবং বলির পাঁঠা হন যতীন চক্রবর্তী।


প্রফুল্লচন্দ্র সেন


জ্যোতি বসু


রাজীব গাঁধী

সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে সিবিআই যখন অভিযোগের তর্জনী উত্থাপন করে তখন মমতা জ্যোতিবাবুর স্টাইলে চলেননি। মমতা উল্টে মদন মিত্র থেকে মুকুল রায়দের পক্ষ নিয়েছেন প্রকাশ্যেই। উল্টে রাজ্য সরকার যে ভাবে সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করছে তাতে বোঝা যাচ্ছে, মমতা কিন্তু জ্যোতিবাবুর মতো নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা করে বাঁচানোর রাজনীতি করছেন না। কেউ কেউ বলছেন, মমতা এটা করছেন না পাছে মুকুল, মদন সরাসরি তাঁর বিরুদ্ধেই পাল্টা কুত্‌সা করার সুযোগ পান।

অটলবিহারী বাজপেয়ীও গোধরা কাণ্ডের পর যখন নিজেকে মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার রাজনীতি করেন, তখন লালকৃষ্ণ আডবাণী প্রকাশ্যে মোদীর পক্ষে অবস্থান নেন। তবে সে ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিষয়। দুর্নীতি নয়।

পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আজও অনেকেই মনে করেন, মমতা ব্যক্তিগত ভাবে সত্‌। তৃণমূল নেতারা বলছেন, গোয়েবল্‌সের কায়দায় এখন মমতার বিরুদ্ধে অপপ্রচার হচ্ছে। একসময় সিপিএম জ্যোতিবাবু বিরোধী প্রচার সম্পর্কেও এই কথাই বলতেন।

আমি কিন্তু অন্য কথা বলছি। আমি বলছি, পারসেপশনের কথা। সত্য কী, তা তদন্তের বিষয়। কিন্তু মানুষের মনে কী ধারণা তৈরি হচ্ছে সেটাও কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শুধু সত্‌ হলেই চলে না, সত্‌ বলে রাজনৈতিক নেতাদের বা দলকে প্রতিভাতও হতে হয়। গত তিন বছরে এই ধারণায় যে একটা চিড় ধরেছে মমতা-সরকার সম্পর্কে, এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন